আবার অরণ্য by মো. সাইফুল্লাহ

ঢাকার অদূরে, গাজীপুরে চালু হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। বাঘ, সিংহ, হাতি, জিরাফ, জেব্রা—কী নেই সেখানে! গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ রোড ধরে সোজা এগোলে বাঘের বাজার।
ময়মনসিংহের সিংহ কিংবা বাঘের বাজারের বাঘ—কোনোটাই আমাদের চোখে পড়ে না।বাঘ-সিংহের সাক্ষাৎ পেতে আমরা তাই পশ্চিমের সরু পথ ধরে রওনা হই। আনুমানিক তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছাই গন্তব্যে। চোখে পড়ে বিরাটকায় ফটকের ওপর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর।’ কয়েক দিন আগে উদ্বোধন হওয়া নতুন এই সাফারি পার্ক ঘুরে দেখতেই ঢাকা থেকে আসা।

জোড়া জেব্রা 
ফটক পেরিয়ে প্রথম দর্শনেই হতবাক—এ কী! বাঘ-সিংহ তো বটেই, বাজপাখি, ক্যাঙারু, এমনকি ডাইনোসরও আছে! তবে এগুলো প্রাণহীন; মাটি, বালু, সিমেন্টের ওপর ভাস্করের কারুকাজ। নরম ঘাসের মাঠ, ফুলের গাছ, মাঝে বাঁধাই করা টলটলে পানির ফোয়ারা। পার্কের এ অংশটুকু কেবল দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানোর জন্য। আমাদের স্বাগত জানালেন পার্কের ওয়াইল্ড লাইফ সুপারভাইজর মো. সরোয়ার হোসেন খান, ফরেস্টার মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ পার্কের কর্মীরা। ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার’র কারণে এদিন দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। তাই সরোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীর আলমরাও আমাদের সঙ্গে দর্শনার্থী বনে গেলেন। ছোটখাটো একটা দল নিয়ে আমরা রওনা হই মূল সাফারি পার্কের দিকে।

এরই মধ্যে পার্ক সম্পর্কে আমাদের একটা ছোটখাটো ধারণা দিলেন সরোয়ার হোসেন, ‘সাফারি পার্ক আর চিড়িয়াখানার মধ্যে পার্থক্য হলো, চিড়িয়াখানায় পশুপাখি থাকে বন্দী আর মানুষ থাকে উন্মুক্ত। এখানে তার উল্টো। পশুপাখি উন্মুক্ত আর মানুষ থাকবে বন্দী। পশুপাখিরা যেন বনের স্বাভাবিক পরিবেশটা এখানে পায়, সে জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়। আমাদের পার্কের সাড়ে তিন হাজার একরের বেশি জায়গা জুড়ে বর্তমানে দেশি-বিদেশি ৩১ প্রজাতির পশুপাখি আছে।’

সাফারি পার্কের প্রবেশপথ 
পার্কের একজন কর্মী আমন্ত্রণ জানালেন, ‘আসেন, আমরা টাইগার রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করি।’ টাইগারদের রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখতে আপত্তি নেই, তবে রেস্টুরেন্টে ‘মামা’দের খাবার হিসেবে ‘পরিবেশিত’ হতে চাই না! ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল, সে ভয় নেই। শক্ত কাচে ঘেরা রেস্তোরাঁ, আয়তনে বেশ বড়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দর্শনার্থীরা দেখতে পারে কাচের বাইরে ‘টাইগার সাফারি’, এখানেই ঘোরাফেরা করে পার্কের বাঘগুলো। ‘ওওওই যে, ওই দিকে দেখেন, গাছের আড়ালে। ওই যে ডান পাশে আরেকটা!’ বলছিলেন পার্কের এক কর্মী।

দুই হাতির দোস্তি: আমির বাহাদুর আর বেলকলী 
রেস্টুরেন্ট ঘিরে রেলিং দেওয়া কিছুটা বাড়তি জায়গা। পার্কের আরেকজন কর্মী সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন, ‘আয় আয়! কাম কাম!’ বাংলা কিংবা ইংরেজি, কোন ডাকে কে জানে, বাঘেরা সাড়া দেয়! হেলেদুলে পা বাড়ায় রাজকীয় প্রাণীটি, আমরা মুগ্ধ চোখে দেখি! স্পষ্ট চোখে পড়ে, বনের নানা দিক থেকে ছয়টি বাঘ এগিয়ে আসছে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়, বুঝি বিশাল কোনো টিভির পর্দায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দেখতে বসেছি!

মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই সরোয়ার হোসেন জানান, গাড়ি এসে গেছে। বেশ প্রশস্ত মাইক্রোবাসে চেপে আমরা ঢুকে পড়ি টাইগার সাফারির ভেতর। সেখানে আরও চমকপ্রদ কাণ্ড! পায়ে পায়ে ছয়টি বাঘ ঘিরে ধরে আমাদের। পিলে চমকে ওঠে! ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করি, এদের আজ খাবার দেওয়া হয়েছে তো? সরোয়ার হেসে বলেন, ‘আজ বাঘদের উপোসের দিন। খাদ্যতালিকার অংশ হিসেবেই সপ্তাহের এক দিন ওদের খাবার দেওয়া হয় না।’ বাহ্, বাঘেরাও ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ করে, জানা ছিল না!

মামাদের টা টা জানিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি সিংহের রাজ্যে। বনের রাজারা অমন ঘিরে না ধরলেও দূর থেকে স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের মতো কড়া চোখে তাকায়। গাড়ির ভেতর থেকে ডাকাডাকি করেও এদের কাছে আনা গেল না। ও হ্যাঁ, গাড়িতে বসে আপনি বাঘ-সিংহের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, চাইলে ভেংচিও কাটতে পারেন! শুধু একটা শর্ত, জানালা খোলা যাবে না! যেতে যেতে সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ১১টা বাঘ আর নয়টা সিংহ আছে। একটা সাদা সিংহও আছে। ওটাকে আপাতত অন্য জায়গায় রাখা হয়েছে।’
এরপর একে একে দেখা হলো ভালুক, হরিণ, ব্লেসবক, জেব্রা, আফ্রিকান ওয়াইল্ডিবিস্ট। এদের বিরক্ত না করে আমরা ধীরগতিতে এগিয়ে যাই। আমির বাহাদুর আর বেলকলীকে দেখে থামতে হলো। মাহুত কুকিল চাকমার ইশারায় আমাদের সালাম ঠুকল বিশালদেহী হাতি দুটো। কুকিল জানান, আমির বাহাদুর আর বেলকলী ছাড়াও তাঁদের আরও দুটো হাতি আছে। পূজা রানি আর কুসুম মালা। অদ্ভুত ভাষায় এদের সঙ্গে কথা বলেন কুকিল। ‘আচ্ছাইযে গুড় গুড় গুড়’ বলে গায়ে চাপড় দিতেই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায় হাতি দুটো।
গা ভেজাতে পানিতে নামল দুই বাঘ 
জিরাফগুলোকেও কাছ থেকে দেখার লোভ সামলানো গেল না। আলোকচিত্রী ছবি তুলবেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। জিরাফের দেখাশোনা করেন রুপন কান্তি পাল। বললেন, ভয় নেই, কাছে না গেলেই হলো। লম্বা লম্বা চারটা জিরাফ, কী খায় এরা? রুপন বলেন, আগে তো এরা আফ্রিকার বিভিন্ন গাছের পাতা খেত। এখানে সেসব গাছ হয় না। তবে এখানকার তেঁতুলপাতা আর কামরাঙা পাতা জিরাফরা পছন্দ করছে। বোঝা গেল, লম্বুগুলোর রুচি পরিবর্তন কার্যক্রম চলছে।
গাড়িযাত্রা এখানেই শেষ। এরপর এগোতে হলো হেঁটে।

ম্যাকাও পাখির আস্তানাটা মুগ্ধ করল ভীষণ। নানা প্রজাতির ম্যাকাও, পার্কের কর্মীদের সাহায্য নিয়ে চাইলে পাখি কাঁধে বসিয়ে ছবিও তুলতে পারেন। তবে সাবধান!, আপনার কান দুটো ম্যাকাওয়ের কাছে লোভনীয় মনে হলে বিপত্তি ঘটতে পারে! গ্রে প্যারটসহ বিভিন্ন প্রজাতির টিয়াগুলোও মুগ্ধ চোখে দেখার মতো।

পার্কের ফেন্সি ডাক গার্ডেনটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে নিশ্চিত। গোলাকার হ্রদ। বিশালাকৃতির ব্ল্যাক সোয়ান, হোয়াইট সোয়ান আর রঙিন ফেন্সি ডাকগুলোকে সঙ্গ দিতে আমরা সেখানে নৌকায় ঘুরে দেখি। এরপর একে একে কুমির, শকুন, ইমু পাখি, উটপাখি, অজগর, গুইসাপ, ধনেশ, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ...দেখতে দেখতে প্রায় বিকেল। মন খারাপ করতে হলো শুধু ময়ূরের ডেরায় গিয়ে। বিশাল এলাকাজুড়ে অনেক ময়ূর, কিন্তু পেখম মেলল না একটাও। সেই দুঃখ কিছুটা ঘুচল মদনটাকের কাছে গিয়ে। বিশাল পাখা মেলে দিয়ে যেন আলোকচিত্রীকে বলতে চাইল, ‘এই যে মশাই, ছবি কিন্তু সুন্দর আসা চাই!’
পার্কের কিছু কাজ এখনো বাকি। প্রজাপতি বাগান, প্রকৃতিবীক্ষণকেন্দ্র আর অবজারভেশন টাওয়ারগুলোর কাজ চলছে। বিনোদনের জন্য চাইলে এই সাফারি পার্ক ঘুরে আসতে পারেন। প্রবেশ মূল্য লাগবে। সকাল নয়টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিদিন পার্ক খোলা। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসে চড়ে চলে যাবেন বাঘের বাজার, সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজিতে সোজা সাফারি পার্ক। নিশ্চিত করতে পারি, চোখ কপালে তোলা বিস্ময় অপেক্ষা করছে আপনার জন্য!
রাজকীয়ভাবে ঘুরে বেড়ায় সিংহের দল

No comments

Powered by Blogger.