উপেক্ষিত ভোক্তা স্বার্থ by এমদাদ হোসেন মালেক

২০০৯ সাল থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন দেশে কার্যকর করা হয়। গঠন করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এ দফতরের মহাপরিচালক বা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা, তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জরিমানা আরোপ, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ক্ষমতা রাখেন। ভোক্তা সংজ্ঞার ব্যাখ্যায় কোনো পণ্য বা সেবা গ্রহীতা নগদ, বাকি, আংশিক মূল্য অথবা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের চুক্তিতে যে বা যিনি পণ্য কিনবেন তিনিই ভোক্তা। ভোক্তা আইনে কেউ পণ্য বা সেবা ক্রয় করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে উদ্ভূত ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কিংবা উল্লিখিত জেলা পর্যায়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের বরাবর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তিনি সাদা কাগজে লিখিত অথবা ই-মেইল, ফ্যাক্স অথবা টেলিফোনে প্রমাণসহ নিজ পরিচয় দিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এ আইনের সবচেয়ে ভালো দিকে হচ্ছে ১. অভিযোগ দায়ের করতে কোনো কোর্ট ফি দিতে হয় না। ২. দায়েরকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার আরোপিত ও আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অভিযোগ দায়েরের এতসব ভালো দিক থাকার পরও বিগত প্রায় ৪ বছরে মাত্র ৪০টি অভিযোগ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে জমা পড়ায় দফতরের মহাপরিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে ২১ জুন এবং ৩ জুলাই ২০১৩ জাতীয় প্রেস ক্লাবে ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুটি সভায় বলেছেন, শুধু আইন থাকলেই চলবে না, আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের বরাবর ক্রেতা-ভোক্তাদের সমস্যা জানাতে হবে। নাগরিক সমাজ যদি সে দায়িত্ব পালন না করে থাকেন তাহলে ভোক্তা স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষিত হবে? মহাপরিচালকের এ ধরনের বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায়, আমরা যারা ভোক্তা তারা হয় বেখেয়ালি অথবা দায়িত্ব-কর্তব্যহীনভাবে সংঘটিত অন্যায় মেনে নিচ্ছি। বাস্তবে কি তাই? না, আমরা কিভাবে, কাদের কাছে অভিযোগ করব তাই-ই জানি না।
ধরুন আমি একজন সাধারণ ভোক্তা। রাস্তা সংলগ্ন একটি দোকান থেকে রুটি, কলা, পানি, চা ২০ টাকা দিয়ে খেলাম। খাওয়ার সময় বুঝলাম রুটিটা ভালো না, পানিও বিশুদ্ধ না। এসব খেয়ে রাতে আমার ডায়রিয়া হল। ভোক্তা অধিদফতরে কী প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ করব?
সবাই জানেন, ঢাকা শহরে কোনো মাংসের দোকানে মহিষ ও ভেড়ার মাংস পাওয়া যায় না। সবই খাসি-গরুর মাংস। অথচ প্রতিদিন আমরা দেখি, যে কসাই দশটা গরু কেনেন, তার সঙ্গে তিনি ২-৪টা মহিষও কেনেন। এগুলো জবাই করার পর ক্রেতার কাছে সব মাংসই বিক্রি করা হয় গরুর মাংস নামে। এভাবে ভেড়া-বকরির মাংসও খাসির মাংস হিসেবে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। একজন ক্রেতা মাংস কিনে প্রতারিত হলেন কিনা তা কিভাবে বুঝবেন।
সংবাদমাধ্যম প্রায়ই কলা-আনারস পাকাতে ও সংরক্ষণে নানাবিধ কেমিক্যাল ব্যবহারের সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। মাছে ফরমালিন ব্যবহারের গল্প শুনতে শুনতে এখন শুনছি সরাসরি মাছে ফরমালিন ব্যবহার না করে যে বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয় সেই বরফ তৈরির সময় নাকি পানিতে ফরমালিন মিশিয়ে বরফ তৈরি করা হচ্ছে। ক্রেতা হিসেবে এমনিভাবে বাজার থেকে মাছ, মাংস, ফলমূল, শাকসবজি যা প্রতিদিন আমরা আমাদের পরিবারের লোকদের খেতে দিচ্ছি, এর কোনটি কী পরিমাণে অস্বাস্থ্যকর বা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা নিরূপণ করব কিভাবে? জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে কিভাবে অভিযোগ করব তার কূলকিনারা আমরা সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তারা করতে পারি না। এখন আবার ক্রেতা-ভোক্তার অসহায়ত্বকে খোদ অধিদফতরই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সাধারণ ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে নিয়োজিত এ অধিদফতর কয়টি হোটেল, রেস্তোরাঁর পানি, বাজারের মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফল-ফলাদি পরীক্ষা করিয়ে বলছেন- এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
ভোক্তা আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নমুনা সংগ্রহের ক্ষমতা ইত্যাদি (১) মহাপরিচালক বা তাহার নিকট হইতে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে যে কোন দোকান, গুদাম, কারখানা, প্রাঙ্গণ বা স্থান হইতে যে কোন পণ্য বা পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদানের নমুনা সংগ্রহ করিতে পারিবেন। (২) এই ধারার অধীন গৃহীত নমুনা সম্পর্কে উক্ত উপধারার উল্লিখিত নমুনা বা গবেষণা করার রিপোর্ট বা উভয়ই সংশ্লিষ্ট কার্যধারায় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হইবে।’
ধারা ২৯-এ বলা হয়েছে, ‘মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যসামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা নিষেধ : কোনো পণ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর বলিয়া প্রমাণিত হইলে মহাপরিচালকের পরামর্শক্রমে সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা দেশে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় এইরূপ পণ্যের উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিবার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ঐ সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করিতে পারিবে।’
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক মহোদয় ক্রেতা-ভোক্তার অভিযোগের প্রত্যাশায় বসে না থেকে যদি অধিদফতর গঠনের পর থেকে আইনের ৩১ ধারায় বিতর্কিত ও সন্দেহজনক খাদ্য-খাবারের নমুনা বাজার থেকে জব্দ করে পরীক্ষা করিয়ে আইনের ২৯ ধারার বিধান অনুযায়ী আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন তাহলে এতদিনে ১ কারওয়ানবাজার, টিসিবি ভবন (৮তলা), ঢাকার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরটি জননন্দিত হয়ে উঠত। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে মূল দায়িত্ব পালন করলে দেশের ভোক্তাদের কষ্ট লাঘবে সহায়তা হতো। আমরা সাধারণ ভোক্তারা আশা করব, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মীরা পরস্পর পরস্পরকে বা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার বা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী কেউ কাউকে দোষারোপ না করে নিজ অবস্থান থেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করবেন এবং তাতেই দেশ-জাতি তথা সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
ভোক্তা অধিদফতরের বেলায় এ কথাটির যথার্থতা আরও বেশি। কারণ এ আইন করা হয়েছে অসহায় ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে। জেলায় জেলায় ভোক্তাদের জন্য অফিস খোলা, জনবল নিয়োগ বা বাজার অভিযান করা এগুলো অধিদফতরটির মূল কাজ হতে পারে না। এগুলো পরিপূরক কাজ। বরং উপরে উল্লিখিত আইনের ধারাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নই আজ সবচেয়ে জরুরি। এ প্রতিষ্ঠান মূল কাজে হাত না দিয়ে ভোক্তাদের দোষারোপ করলে তাদের অসহায়ত্ব ও হতাশা আরও বাড়বে। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হবে। একই সঙ্গে মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হবে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৪৫ শতাংশ মানুষ ভেজাল খাবার খেয়ে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে আমরা জানতে পারছি আমরা ভয়াবহ খাদ্য দূষণের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুর মুখে ধাবিত হচ্ছি।
আশা করি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিরা ভোক্তা আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে দেশ-জাতির প্রত্যাশা পূরণে কর্মতৎপর হবেন।
এমদাদ হোসেন মালেক : সাধারণ সম্পাদক, কনজুমারস ফোরাম (সিএফ)

No comments

Powered by Blogger.