সরকারের শেষ সময়ে লোডশেডিং! by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনসমর্থনের বিকল্প নেই। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে সব যুগে রাজনৈতিক দলগুলো তাই জনসমর্থন পেতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, যা গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনেই করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই ওই গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে যা করে তা ভয়াবহ রূপ পায়। যাকে অন্তত গণতন্ত্রের কোনো নিয়মেই ফেলা যায় না। এ কারণে অনেকেই ‘বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই’, ‘এখানে ভোটতন্ত্রের চর্চা হয়’ বলে যে আক্ষেপ করেন, সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। আর ভোটতন্ত্র নির্ভর বাংলাদেশী গণতন্ত্রে ভোটের আগে রাজনীতিকরা জনগণের সমর্থন লাভের জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা করেন না। তারা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ভোটের জন্য মানুষের দরজায় কড়া নাড়তেও দ্বিধা করেন না। দু’দিন আগেও যে ব্যক্তি মাসের পর মাস ঘুরেও এমপি-মন্ত্রীদের সাক্ষাৎ পাননি, ভোটের বাতাস বইতে শুরু করলে হওয়া বদল হয়ে যায়। সেই মন্ত্রী-এমপি তখন ওই ব্যক্তির দরজায় নির্লজ্জভাবে কড়া নাড়ে। নানা ছল-চাতুরীতে মন জয় করতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই- এবারের নির্বাচনী বৈতরণী ভালোভাবে পার হওয়া। আবারও ক্ষমতার মসনদের স্বাদ উপভোগ করা। রাজনীতিকদের এমন চরিত্র নতুন নয়। কিন্তু এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনসমর্থন আদায়ে ‘লোডশেডিং তত্ত্ব’। এরই মধ্যে এ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিনে লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগকে বলে রেখেছি দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে, যাতে মানুষ লোডশেডিং যে ছিল এটা ভুলে না যায়’ (দৈনিক মানবজমিন, ৪ আগস্ট ২০১৩)। এ কারণেই বর্তমানে লোডশেডিং হচ্ছে কি-না, সে বিষয়টি অবশ্য কোনো গণমাধ্যমের সংবাদে উঠে আসেনি। আর বর্তমানে যে লোডশেডিং হচ্ছে তা দিনে দুই ঘণ্টা নয়; অনেক ঘণ্টা। ক’দিন ধরে ঠিক বুঝতে পারছি না, বিদ্যুৎ যায়, না আসে। গরমের কারণে জীবন যাপন কষ্টকর হয়ে পড়ছে। জনগণের জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এ লোডশেডিং কোনো প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি। জাপানের মতো হঠাৎ সুনামিতে অথবা পাকিস্তানের মতো হঠাৎ ভূমিকম্পে আমাদের কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিকল হয়ে পড়েনি। যেখানে গত ১২ জুলাই দেশে রেকর্ড পরিমাণ ৬,৬৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সেখানে হঠাৎ করে এমন ঘন ঘন লোডশেডিং কেন শুরু হল, তার কোনো সদুত্তর এখনও পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়নি। সংবাদ মাধ্যমগুলো থেকে ছিটেফোঁটা যা জানা যাচ্ছে তার সার কথা হল, ২০ সেপ্টেম্বর থেকে সিলেটের কৈলাশটিলা গ্যাসকূপের উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কমলে সারাদেশে দুর্বিষহ লোডশেডিং হতে পারে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনেই বড় ধরনের কোনো ঘাপলা হয়েছে।
তাই এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়। প্রথমত, এমন হতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রীর ‘খাস লোক’ এমনটি প্রমাণ করতে অথবা বাহবা কুড়াতে একটি গ্র“প দুই ঘণ্টার জায়গায় অনেক ঘণ্টা লোডশেডিং করছে, যাতে জনগণের লোডশেডিংয়ের কথা বারবার মনে পড়ে এবং আসন্ন রাজনৈতিক সংকটের সময়ে আওয়ামী লীগের পাশে থাকে। দ্বিতীয়ত, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার সিদ্ধান্ত যে সঠিক তা প্রমাণ করা। তৃতীয়ত, সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতাকারীদের পক্ষে যাতে জনসমর্থন কম হয়, সেই চিন্তা থেকে। আমার এমন ভাবনা শতভাগ সঠিক না হলেও যে ওই রকমটি ভাবার শতভাগ কারণ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চলমান লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সরকার জনগণকে হয়তো এই বার্তা দিতে চাচ্ছে যে, যদি আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় না আসে; তবে আবারও বিদ্যুৎ খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট হওয়ার ফলে লোডশেডিং তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। আর ভয়াবহ লোডশেডিং হলে জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা এখনই উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতি আবার সমর্থন ব্যক্ত করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার হয়তো মানুষের সহজাত প্রবণতার কথা ভুলে গেছে। এদেশের মানুষ খুব সহজে অতীতকে ভুলে যায়। তাই বিরোধী দল বিগত সময়ে সরকারি দলে থাকা অবস্থায় কী কী দুর্নীতি করেছিল, ওই সময়ের সরকার জনবান্ধব ছিল, না জনবিরোধী ছিল তা নিয়ে বর্তমানে তাদের মাথাব্যথা থাকে না। তাই তারা পাঁচ বছর আগে যে সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, পাঁচ বছর পর ঠিকই তাদের আবার ক্ষমতার মসনদে বসায়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসের শিক্ষা এমনই। তাই বিএনপির পর আওয়ামী লীগ আবার আওয়ামী লীগের পর বিএনপি সরকার গঠন করে।
অন্যদিকে, জনগণের এই ভুলে যাওয়ার প্রবণতাই এখন আওয়ামী লীগের জন্য মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের লোডশেডিং তত্ত্বই তাদের জন্য বুমেরাং হবে। কারণ জনগণ যখনই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে, তখনই এর জন্য বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করবে। এমনকি জনবিক্ষোভ শুরু হয়ে যাবে। ফলে লোডশেডিং তত্ত্বে ভেসে যাবে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কৃতিত্ব। কারণ জনগণের মধ্যে ওই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকায় তারা ভুলে যাবে যে, বিগত প্রায় পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লোডশেডিং হয়নি। বরং বর্তমানের লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতা তাদের মনে দাগ কেটে থাকবে। পাল্টে যাবে ভোটের হিসাবনিকাশ। ফলে লোডশেডিংয়ের আগে আওয়ামী লীগ যে কয়টি আসন পেত, এবার সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসবে। অর্থাৎ আসন সংখ্যা আরও কমে যাবে। এছাড়া সরকারকে জনবিক্ষোভের মুখেও পড়তে হতে পারে। এরই মধ্যে অনেক এলাকায় তা শুরু হয়ে গেছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, জনগণের মধ্যে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর লোডশেডিংয়ের এ ধারা অব্যাহত থাকলে সরকার যে কোনো সময় বড় ধরনের গণরোষের মুখেও পড়তে পারে, এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকার যে কয়টি খাতকে তাদের সাফল্য হিসেবে জনগণের মাঝে প্রচার করতে উদ্যোগী হয়েছে, তার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি অন্যতম। কিন্তু এভাবে যদি ভয়াবহ লোডশেডিং চলতে থাকে; তাহলে জনগণের কাছে ওই বিষয়টি প্রচারের যৌক্তিকতা হারাবে।
জনগণের উন্নয়ন করাই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আর সরকার উন্নয়ন করবে- সরকারের কাছে জনগণের এমন চাওয়া জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। জনগণ তার ভাগ্যের পরিবর্তনের আশায় গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তাই সরকার যদি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনে কিছু করে থাকে, তবে তারা তাদের ওই গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.