প্রবীণের জীবন হোক শান্তিময় by ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম আখন্দ

নবীন আর প্রবীণ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নবীনকে প্রবীণ হতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সে পথ কখনোই সহজ সরল নয়। নবীনকে জীবনে যে পথ পাড়ি দিতে হয়, সে পথের নাম জীবনযুদ্ধের পথ। যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে হলে প্রয়োজন দক্ষতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ যত দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবধর্মী হয়, সফলতা তত বেশি। নবীন চিরদিন নবীন থাকে না। ক্রমান্বয় সে হয় প্রবীণ। আর প্রবীণের পরিসমাপ্তি হয় ‘মৃত্যু’র মধ্য দিয়ে। আমাদের দেশে প্রত্যেক পরিবারেই নবীন প্রবীণের সংমিশ্রণ থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্যে নবীন প্রবীণের সংমিশ্রণ খুব কমই দেখা যায়। সেখানে নবীন যখন ক্রমান্বয় কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেয়, তখন তার শরীরে থাকে তেজ-উদ্যম-শক্তি-সামর্থ্য। তখন তার আর অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। তখন সে হয় গৃহত্যাগী। প্রবীণদের সঙ্গ অর্থাৎ বৃদ্ধ বাবা-মা’র সঙ্গ তার ভালো লাগে না। তাদের অসহায় অবস্থায় ফেলে অন্যত্র যেতে দ্বিধাবোধ করে না। আমি নিজে এমন দুই অসহায় প্রবীণ- একজন বৃদ্ধা আর একজন বৃদ্ধকে দেখেছি অস্ট্রেলিয়ায়। আমার এক ছেলের চাকরির সুবাদে সেখানে কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমি আমার ছেলের পরিবারের সঙ্গে থাকতাম। তার ছেলেমেয়ে ছিল। কাজেই আমার নাতি-নাতনীসহ তিন প্রজন্মের একত্র বসবাস ছিল। আমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টা চলত। মন খুলে কথা বলার সুযোগ ছিল। মৌনতা মোটেই ছিল না। আর আমাদের দু’পাশে? এক পাশে এক বৃদ্ধা একটি দোতলা বাসায় এবং অন্য পাশে এক বৃদ্ধ একাকী একটি একতলা বাসায়। প্রত্যেকের সঙ্গে একটি করে কুকুর ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সঙ্গী ছিল না। হয়তো তারা নিজেই রান্না করে খেতেন, অথবা হোটেল থেকে কিনে আনতেন (সেখানে কাজের লোক পাওয়া যায় না)। নিজ বাড়িতেই জেলখানা। বন্দিজীবন। এমন জীবনে যখন হঠাৎ মৃত্যৃ আসবে, তখন এক গ্লাস পানি দেয়ারও লোক পাওয়া যাবে না। মরে থাকবে। দূরে বসবাসরত কোনো আত্মীয়ও তার মৃত্যুর খবর পাবে না। টেলিফোন-মোবাইলে যখন কোনো খবর পাবে না, তখন হয়তো মনে করবে একটা কিছু হয়েছে। আর যদি কেউ খোঁজখবর নেয়ার মতো না থাকে, তবে পচে দুর্গন্ধ ছাড়ানোর আগে কেউ জানবে না। প্রবীণের কী করুণ পরিসমাপ্তি! এমনটি যেন আমাদের কারও না হয়।
সৌভাগ্যক্রমে আমার সংসার নবীন-প্রবীণের মিশ্রণে। কয়েক ছেলের মধ্যে এক ছেলের সঙ্গে আমার বসবাস। আমার এক নবীন নাতি আছে সেই সংসারে। আমার নাতি-নাতনীর সংখ্যা ৯। একজন ছাড়া সবারই অবস্থান দূরে। কাজেই একজনের সঙ্গেই আমার ওঠাবসা, গল্পগুজব, এমনকি খেলাধুলাও। নাতিটি টিভির খুব ভক্ত। বিশেষ করে কার্টুন ছবির। কার্টুন নিয়ে সে বেশ সময় কাটাতে অভ্যস্ত। একদিন তার সঙ্গে আমার কথোপকথন হচ্ছিল। হঠাৎ করেই শিশুসুলভ মনে জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা দাদু, টিভির ভেতর কি ঢোকা যায়? হ্যাঁ, ঢোকা যায়। কেমন করে ঢোকা যায়? ঢাকায় টিভির অফিস আছে। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করতে হয়। ছোট বাচ্চারাও কি ঢুকতে পারবে? হ্যাঁ ঢুকতে পারবে। আমাকে কি ঢুকিয়ে দিতে পারবে? হ্যাঁ, পারব। কখন পারবে? তোমার স্কুল যখন ছুটি হবে। টিভিতে ঢুকলে কি আবার বের হওয়া যাবে? হ্যাঁ, বের হওয়া যাবে। ঢোকার পর যদি বের হওয়া যায়, তাহলে কি আমাকে একবার ঢুকিয়ে দেবে? তাকে পুরো নিরাশ না করে বললাম, পরবর্তী সময়ে যখন ঢাকা যাব, তখন চেষ্টা করে দেখব। সে খুব আশ্বস্ত হয়ে সান্ত্বনার সঙ্গে বলল, আচ্ছা।
অন্য একদিন আমি ও আমার নাতি রিকশায় ব্রিজ দিয়ে করতোয়া নদী পার হচ্ছিলাম। নিচে পানি দেখে নাতি বলল, নিচে পানি কেন? বললাম, ওটা বগুড়ার করতোয়া নদী। এত ছোট নদী কেন? যমুনা নদীর মতো বড় ও বেশি পানি নেই কেন? (ইতিপূর্বে বাসে যমুনা ব্রিজ পার হয়ে তার ঢাকায় যাতায়াতের অভিজ্ঞতা হয়েছে)। বললাম, নদী মরে গেছে। নদী কেমন করে মরে? বললাম, পানি নাই, তাই মরে গেছে। পানি থাকে কেন? বললাম, অনেক কারণেই পানি থাকে না। এই নদীতে মাছ পাওয়া যায়? বললাম, পাওয়া যায়। মাছ ধরা যাবে? বললাম, ধরা যাবে। কেমন করে ধরা যাবে? বললাম, বড়শি দিয়ে। আমাকে বড়শি কিনে দেবে? বললাম, দেব। আমি ওই বড়শি দিয়ে অনেক মাছ ধরব। মাছ ধরে কী করবে? রান্না করে মজা করে খাব। কাকে কাকে দেবে? তোমাকে, বুবুকে, মাকে, বাবাকে (আমাদের বাসায় ওই ক’জনই লোক)। তার শেষের জবাবটাই বেশি বিবেচ্য। কারণ তাতে স্বার্থপরতার কোনো গন্ধ নেই। সবার সঙ্গে ভাগাভাগিতে সে বিশ্বাসী। এটা উদার মনের পরিচায়ক।
বড় হয়ে যদি তার ভেতর শেষোক্ত গুণটি বজায় থাকে, তাহলে নবীন-প্রবীণে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। তাদের সহাবস্থান হবে প্রকৃতই মধুর ও শান্তিময়। আমরা সবাই নবীন ও প্রবীণের এমন শান্তিময় জীবনই প্রত্যাশা করি। আমরা পাশ্চাত্যের নবীন-প্রবীণের মতো হতে চাই না। আমরা প্রাচ্যের নবীন-প্রবীণ হতে চাই- আমরা তা-ই আছি, তা-ই থাকব। আমাদের নবীন-প্রবীণের এই মজবুত বন্ধনটি চির অটুট থাকুক। আমরা একে অপরের পরিপূরক হই এবং হওয়ার চেষ্টা করি।
আমরা ইসলামের ইতিহাস থেকে জানতে পারি, এক নবীন নিজের অতি প্রিয় জীবন উৎসর্গ করে এক প্রবীণকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়তা করেছিলেন। তার নাম হজরত ইসমাইল (আঃ)। হজরত ইসমাইল (আঃ)-এর মতো নবীন ঘরে ঘরে জন্ম লাভ করুক।
ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম আখন্দ : চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.