গণতন্ত্র সুরক্ষার দায়িত্ব by একেএম শাহ নাওয়াজ

ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল ও এর পরিচালক রাজনীতিকরা গত চার দশকে গণতন্ত্র চর্চার বদলে তা ধ্বংস করায় ভূমিকা রেখেছেন বেশি। একদিকে দলের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চার রেওয়াজ একরকম উঠিয়ে দিয়ে একনায়কতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর অন্যদিকে দলীয় প্রধানরা মেলা বসিয়েছেন তোষামুদেদের। তাই দলতন্ত্রের কঠিন আবর্তে পেশিশক্তি মর্যাদা পেয়েছে আর দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করেছে। এসব কারণে অপার সম্ভাবনার এই দেশটি এগিয়ে চলার পথে বারবার হোঁচট খেয়েছে- হোঁচট খাচ্ছে। অথচ এদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই গণতন্ত্রকে ধারণ করতে চায়। গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি। তাই সাধারণ মানুষ সহায়তা করতে পারলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র সুরক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হয়। ১৯৭২-এর পর সদ্য স্বাধীন দেশে সংবিধান প্রণয়নের পথ ধরে গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। শাসন ব্যর্থতা আর নষ্ট মানুষদের বৃত্তে আটকে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যার অনিবার্য পরিণতি ছিল ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষ। আওয়ামী নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছিল দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায়। অবাধ দুর্নীতি, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি অস্থির করে তুলেছিল আওয়ামী লীগের শাসন কাঠামোকে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি অবস্থা জারি দলটির জন্য কোনো সুখকর পরিপ্রেক্ষিত রচনা করতে পারেনি। গণমানুষের সঙ্গে এই প্রথম কিছুটা দূরত্ব তৈরি হতে থাকে আওয়ামী লীগের। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে একদলীয় বাকশালের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাকশালের ভেতর সাময়িক আত্মগোপন করে আওয়ামী লীগ। বাকশাল গঠন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, আছে নানা অভিযোগ। আমি সময়ের প্রয়োজনে বাকশাল গঠনকে পজিটিভভাবে দেখার চেষ্টা করেছি।
ইউরোপের ইতিহাস থেকে উদাহরণ নেয়া যেতে পারে। দেশের বিপর্যস্ত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে চাইছিল, তখন বোধকরি আঠারো শতকের ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা দেশের অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এনলাইটেন্ড ডেসপটিজম (বুদ্ধিদীপ্ত স্বৈরাচার) বা বেনেভোলেন্ট ডেসপটিজম (কল্যাণকামী স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্র)। নানা দল-মতের চিন্তার স্বাধীনতা যখন সুবিধাবাদ আর নৈরাজ্যকে উসকে দিচ্ছিল, তখন অনন্যোপায় রাজারা শক্তহাতে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। কোনো মানবিক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। ফলে দেশ আবার অন্ধকার থেকে আলোয় চলে আসে। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। প্রশাসন আবার একটি শক্ত ভিত পেয়ে যায়। স্বৈরাচার হয়েও তাই বিশ্বনন্দিত হয়েছেন রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথরিন, প্র“শিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডারিক, রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় জোসেফ, স্পেনের তৃতীয় চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম নেপোলিয়ন প্রমুখ। ইউরোপের বুদ্ধিদীপ্ত স্বৈরাচার জনপ্রিয়তা পেলেও বাকশাল নিজের ভেতর আত্মগোপনকারী আওয়ামী লীগকে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা শক্তি লুফে নেয় এই সুবিধাটিই। এই সূত্রেই ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে। সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারা নিশ্চয়ই মেধাবী! বলা ভালো ‘ইভিল জিনিয়াস’। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে পঙ্গু করার জন্য এবং বঙ্গবন্ধু-উত্তর আওয়ামী মেধা নিঃশেষ করার জন্য ‘সাফল্যের সঙ্গে’ জেলহত্যা সম্পন্ন করা হয়। এবার রাজনীতির মাঠে ছুড়ে ফেলে দেয় প্রায় রাজনৈতিক পঙ্গু আওয়ামী লীগকে। পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের রাজনৈতিক অদক্ষতা স্পষ্ট হতে থাকে। দেশ তখন নানা মত-পথে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি, ডান-বাম, মধ্যপন্থা প্রভৃতি ইস্যু তো আছেই- এছাড়া ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী সব সামাজিক শক্তিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আর এর মোকাবেলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দূরদর্শী চিন্তা করতে পারেনি সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এই ব্যর্থতার সুবিধা পুরোটাই নিতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান। জাতীয়তাবাদী স্লোগানে নানা মত-পথের মানুষকে নিয়ে বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।
এসব ইতিহাস এখন আর নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তারপরও মনে করিয়ে দিতে হয়। যাতে রাজনীতিকরা সম্বিত ফিরে পান। আত্মসমালোচনা ছাড়া শুদ্ধ হওয়া কঠিন। কারণ আমরা অসহায়ভাবে দেখছি, গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে পেশিশক্তি আর অর্থশক্তিকেই যেন প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছেন আমাদের রাজনীতিকরা। এই অবস্থা থেকে আমাদের রাজনীতি বেরোতে পারছে না। গণতান্ত্রিক আচরণ অপসৃত হতে থাকে দলগুলোর আচরণ থেকে। গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেকে তৈরি করেছিল জন্মলগ্ন থেকে। সেই দলের এ সময়ের নেতানেত্রীর আচরণে গণতন্ত্র ফিকে হয়ে যেতে থাকে। একটি রাজনৈতিক দলের পরিচিতি, এর চালিকাশক্তি দলের রাজনৈতিক আদর্শ। বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই আদর্শই যদি আপসকামিতার বেড়াজালে বন্দি হয়ে যায়, তাহলে দলের ভালো বলে কিছু থাকে না। দলকে নতুন করে দাঁড়াতে হলে ওই আদর্শকে সামনে নিয়েই দাঁড়াতে হয়।
আমাদের এমন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এখন আদর্শেরই বড় অভাব। দৃশ্যমান আদর্শ একটিই, তা হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতার রাজনীতিকরা এতটাই জনসেবক যে জনগণ কোনো পক্ষের সেবা না চাইলেও যে কোনো পন্থায় তারা সেবা করবেনই। তাই মসনদ দখলে এত কৌশল। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবে তাদের রাজনৈতিক আচরণ দেখাতে পারছে না। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজ দলকে শক্তিমান করতে প্রয়োজন দল সুসংগঠিত রাখা। আর এপথে প্রয়োজন দলের ভেতর গণতান্ত্রিক আচরণ বজায় রাখা। কিন্তু যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সাধারণ মানুষকে রাজনীতিকরা জিম্মি করেন, জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি করে সুবিধার ফসল নিজ ঘরে নিতে চান, তখন বিশ্বাস করতে মন চায় না তারা গণতন্ত্রের পথে হাঁটবেন।
বিএনপির কথাই যদি বলি, দলটির ভেতর আদর্শ যদি বজায় থাকত তবে দলের সংহতি রক্ষা প্রধান কর্তব্য হতো। গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ঝড় এবং বিগত নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ার পর দলকে সুসংগঠিত করার দিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি ছিল। তারেক জিয়া তরুণ অনুসারীদের সংগঠিত করার একটি চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নিজেদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হওয়ায় পরবর্তী ঝড় সব উল্টে দেয়। সার্বিকভাবে বিএনপি ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদগ্র আগ্রহ যতটা দেখিয়েছে, তার সিকিভাগ আগ্রহও দেখায়নি সারাদেশে দলকে সুসংগঠিত করার দিকে। দল সুসংগঠিত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা করা। কিন্তু সে পথ না মাড়িয়ে কতটা সহজ পথে ক্ষমতাসীন হওয়া যায় সে পথেই হাঁটতে চেয়েছে। তাই নিজ সাংগঠনিক দুর্বলতার অভাব মেটাতে চেয়েছে জামায়াত-হেফাজতের মতো মৌলবাদী দলগুলোর পেশিশক্তিকে ধারণ করে। বিএনপির জোট আঠারো দলে রূপান্তরিত হয়ে কী অর্জন করতে পেরেছে তা বিএনপি বুঝবে, তবে এখানে যে আভিজাত্যের সম্মিলন ঘটেছে তা বলা যাবে না। দলগুলো এমন যে পরীক্ষায় এই আঠারো দলের নাম বলতে বললে অধিকাংশ পরীক্ষার্থী ডাহা ফেল করবে। তার মধ্যে নামসর্বস্ব কয়েকটি দল আছে যাদের দলীয়প্রধানদের নাম অনেকে জানেন। তাদের কেউ দীর্ঘদিন রাজনীতি করার কারণে পরিচিত। কেউ আবার পত্রিকায় কলাম লিখে পরিচিত। তারা একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে স্খলনটি এমন হয়েছে যে, জীবনের শেষ ধাপে এসে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধার উজ্জ্বল পোশাকটি অবলীলায় খুলে ফেলে জোটবন্ধু জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে প্রতিদিন মুসাফা করছেন। বিএনপির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জামায়াত ও হেফাজতের জয়গান গাইছেন। এসব সম্ভব হচ্ছে গণতান্ত্রিক আচরণ ও শিক্ষা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে।
আওয়ামী লীগের নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু বলতেই হবে এ যুগের আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা বিভ্রান্তির চোরাবালিতে, কেবল নিমজ্জিতই হচ্ছেন। ক্ষমতান্ধ না থেকে গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতিতে দেশজুড়ে দলকে সংগঠিত করার প্রয়াস গত দু-তিন দশকে নেয়া হয়েছে কেউ বলতে পারবেন না। দলের ভেতর গণতান্ত্রিক আচরণের কোনো প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না। ফলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সব দলের ভেতরের ছবি অভিন্ন। তাই সরকার পরিচালনায় যে দল যখন আসীন হয় তখন একইভাবে উপেক্ষিত হয় জনগণ। দলীয় সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত হয়। প্রশাসনিক দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা মেলে। সব দলের সরকার পরিচালকরা একই ছন্দে মার্চপাস্ট করেন।
এমন মরচে ধরা রাজনৈতিক অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্রমে দুর্বল করে দিচ্ছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য সুখকর সংবাদ নয়। আমরা যত আলোচনা-সমালোচনা করি না কেন, দেশে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষা করতে হয় তবে তা করার মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। এখন দলগুলোর নেতানেত্রীদের যে চরিত্র, তাতে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তারপরও যেহেতু আমরা অনন্যোপায় তাই এই রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দিকে তাকিয়েই আশায় বুক বাঁধতে হয়। এ কারণে প্রত্যাশা করব আমাদের রাজনীতিকদের ভেতর থেকে দেশপ্রেমের প্রণোদনা উৎসারিত হবে। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.