প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রত্যাশায় by কামরুল ইসলাম চৌধুরী

প্যারিসে তখন ঝকঝকে রোদ। ব্রাসেলস থেকে দেড় ঘণ্টার ট্রেনযাত্রা শেষে ফরাসি রাজধানীতে পৌঁছে পেলাম দুপুরের এক টুকরো রোদ। আলেক্স জানাল, মধ্যাহ্নভোজ সেরে যেতে হবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। ফরাসিরা আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রত্যাশা জানতে আগ্রহী। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় সম্মেলন নিয়ে আমাদের ভাবনার কথা বলতে হবে। ৩ অক্টোবর বিকাল। ফরাসি প্রেসিডেন্টের জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়ন উপদেষ্টা প্রাসাদে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। কুশল বিনিময় শেষে শুরু করলেন বৈঠক। জানালেন, ফ্রান্স ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সম্মেলন সফল করতে কোনো কার্পণ্য হবে না। তবে আইনগত বাধ্যবাধক বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির খসড়া তৈরির নানা প্রতিকূলতা আর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কথাও তুলে ধরলেন। তাকে বললাম, গোটা বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে প্যারিসের দিকে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষত বাংলাদেশসহ ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ, ৪২টি দ্বীপরাষ্ট্র এবং ৫২টি আফ্রিকার দেশ প্রত্যাশা করছে, ২০১৫ সালে আইনগত বাধ্যবাধক জলবায়ু চুক্তি হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমবে। কার্বনমুক্ত উন্নয়ন অর্থনীতির দিকে সব দেশ জোর কদম ফেলবে। নাম হবে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। বিশ্ব কূটনীতির প্রধান এক সূতিকাগার প্যারিসে সে চুক্তি তৈরিতে নেতৃত্ব দেবে ফ্রান্স। উন্নত আর উন্নয়নশীল অনেক দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে এখন থেকে চালাতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায় দৌড়ঝাঁপ, সলাপরামর্শ।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে ২০১১ সালে জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ডারবান প্লাটফর্মের কথা স্মরণ করিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানালাম, ডারবানের সফলতার পেছনে ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশের, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আগামী নভেম্বরে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনকে সফল করতে হবে। সেসব দেশকে আবার অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ ইতিমধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমিয়েছে। দেখিয়েছে কার্বন ব্যবহার কমানো যায়। এতে অর্থনীতির চাকাও সচল থাকে, কর্মসংস্থান কমে না; বরং বাড়ে। অর্থনীতি সবুজ, সতেজ হয়। বললাম, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য দেশগুলোকে ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে কার্বন ব্যবহার আরও কমানোর ঘোষণা দিতে হবে। তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত অন্য দেশগুলোর ওপরও কার্বন কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। তবেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড়-দুই ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে। নইলে আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলের পঞ্চম অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তারা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা ৯৫ ভাগ নিশ্চিত। জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে। কার্বন ব্যবহার জরুরিভাবে কমাতে হবে বিশ্বজুড়ে। নইলে কোনো খাপ খাওয়ানোর কৌশলেই কাজ হবে না। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব বাড়বেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা হবে বিপন্ন। খাদ্য, কৃষি ও পানি নিরাপত্তা হবে বিপন্ন। জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে কোটি কোটি।
বাংলাদেশ নেগোশিয়েশন টিমের জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. এম আসাদুজ্জামান তুলে ধরলেন জলবায়ু পরিবর্তনের নানা তথ্য-উপাত্ত। কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন জলবায়ুর কষাঘাতে তলিয়ে যেতে পারে, সে শংকার কথাও তিনি জানালেন। জলবায়ুতাড়িত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরলেন ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ।
আসন্ন ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয় ও ক্ষতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন চাইলে ফরাসি উপদেষ্টা ইতিবাচক সাড়া দেন। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নে ফ্রান্সসহ ইউর অর্থায়ন, জলবায়ু অর্থায়ন জোরদার, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধি, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তহবিল আর অ্যাডাপটেশন ফান্ডে অর্থায়নের জোর দাবি জানালে তিনি আশ্বস্ত করেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয় ও ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আর ভবিষ্যৎ ঝুঁকি কমাতে কার্যকর আন্তর্জাতিক তহবিল গঠনে তার সমর্থনও আমরা কামনা করলাম। ফরাসি উপদেষ্টা বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমর্থন চাইলেন।
পরদিন ফরাসি পরিবেশ, টেকসই উন্নয়ন ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জলবায়ু, পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক চলে। জলবায়ু দরকষাকষি, নয়া জলবায়ু চুক্তির আদল, অর্থায়ন, অভিযোজন আর ক্ষয় ও ক্ষতি নিয়ে চলে বিস্তারিত আলোচনা। কথা হয় পুরনো বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে অনেকটা খোলাখুলিভাবে।
প্রত্যাশা রইল, প্যারিসের সামগ্রিক আলোচনার ইতিবাচক ফল আমরা নভেম্বরে ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে খানিকটা হলেও দেখতে পাব। ২০১৫ সালে হয়তো আমাদের দেখা মিলবে প্যারিস প্রটোকলের- যে চুক্তিতে থাকবে কার্বন ব্যবহার দ্রুত কমানোর বাধ্যবাধকতা। অভিযোজন, অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা আর ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির আইনগত কাঠামো থাকতে হবে সেই প্যারিস প্রটোকলে।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী :জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন কমিটির সদস্য, জলবায়ু নেগোশিয়েশনে স্বল্পোন্নত ৪৯টি দেশের অন্যতম শীর্ষ দরকষাকষিকারী

No comments

Powered by Blogger.