তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে নাগরিক অধিকার হরণের আশংকাই বেশি by ইকতেদার আহমেদ

যে কোনো ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আর তাই যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে সাজা প্রদানের দায়িত্বটি রাষ্ট্র পালন করে থাকে। অপরাধের ধরন, প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিবেচনায় অপরাধগুলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করে পুনঃ শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে। এ তিনটি শ্রেণীর একটি হচ্ছে আমলযোগ্য ও অ-আমলযোগ্য। আর অপর দুটি হচ্ছে জামিনযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য ও অ-আপসযোগ্য। আমাদের দেশে সচরাচর যেসব সাধারণ অপরাধ সংঘটিত হয় সেই অপরাধগুলো দেশের প্রধান দণ্ড আইন দণ্ডবিধি ১৮৬০-এ বর্ণিত আছে। দণ্ডবিধির অপরাধগুলোর বিচার পদ্ধতি ও শ্রেণী বিভাগ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সাধারণ আইনের বাইরে কিছু বিশেষায়িত অপরাধ রয়েছে এবং এসব বিশেষায়িত অপরাধ বিষয়ে কতিপয় বিশেষ আইন রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ একটি বিশেষায়িত আইন। অধিকাংশ বিশেষায়িত আইনে বিচার পদ্ধতি, আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। কোনো বিশেষায়িত আইনে এসব বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানাবলী প্রযোজ্য হয়।
যে কোনো আইন সাধারণ বা বিশেষায়িত যে ধরনের হোক না কেন, তা প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বলা হয়েছে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে আইনটি প্রণীত হয়েছে।
সমাজে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সময় ও যুগের চাহিদানুযায়ী আইন প্রণয়ন করা হয় এবং আইন প্রণয়ন পরবর্তী সমাজের গতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সময় ও যুগের চাহিদানুযায়ী আইনকে সময়োপযোগী করার আবশ্যকতা দেখা দিলে সংযোজন, বিয়োজন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয় এবং অনেক সময় নির্ধারিত বিষয়ে আইন না থাকলে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পুরনো আইন সম্পূর্ণ বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ প্রণয়ন পরবর্তী ৭ বছর অতিক্রান্তের আগে প্রথমে অধ্যাদেশ এবং পরবর্তী সময়ে আইনের মাধ্যমে আইনটির ৫৪, ৫৬, ৫৭, ৬১ ও ৭৬- এ পাঁচটি ধারায় সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনীগুলো বিল আকারে সংসদে উত্থাপনকালে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের জন্য আইনটি যুগোপযোগী করে বাস্তবতার আলোকে কতিপয় ধারা ও উপধারার পরিমার্জন ও সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় বিলটি প্রণয়ন করা হল।
২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়নকালে এ আইনের অধীন অপরাধগুলোর বিষয়ে বলা ছিল অ-আমলযোগ্য হবে এবং জামিন বিষয়ে জামিনযোগ্য অথবা অ-জামিনযোগ্য- এ প্রসঙ্গে কোনো কিছু উল্লেখ ছাড়াই বলা ছিল, রাষ্ট্রপক্ষকে না শুনে জামিনের আদেশ প্রদান করা যাবে না।
যে কোনো আইনে বর্ণিত কোনো অপরাধ অ-আমলযোগ্য হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিরেকে একজন আসামিকে আটক করতে পারেন না। অপরদিকে অপরাধটি আমলযোগ্য হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিরেকে আটকের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
ফৌজদারি কার্যবিধিতে জামিনযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য এ দুটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া থাকলেও উভয় ক্ষেত্রে একজন বিচারক স্বীয় পরিণামদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও স্ববিবেক দ্বারা তাড়িত হন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ প্রণয়নকালে এ আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১- এ চারটি ধারায় অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান ছিল। কিন্তু অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ চারটি ধারায় কারাদণ্ড সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং ন্যূনতম ৭ বছর করা হয়। অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করা হলে কারাদণ্ড বিষয়ে একই বিধান অক্ষুণœ রাখা হয়। উল্লেখ্য, আগের আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি গ্রহণের আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু আইনটিতে প্রথমে অধ্যাদেশ ও পরবর্তীকালে সংশোধন আইনের মাধ্যমে সংশোধনী এনে উপরোক্ত চারটি ধারার অপরাধ আমলযোগ্য করায় পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে মামলা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতার আর কার্যকারিতা নেই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধ্যাদেশটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর দেশের সুশীল সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক ও সচেতন জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয় এবং অধ্যাদেশ থেকে বাক-স্বাধীনতা হরণের ৫৭ ধারা বাতিল করে জাতীয় সংসদে অধ্যাদেশটি অননুমোদনের দাবি জানানো হয়। তাছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে আটকের ক্ষমতা প্রদানেরও তীব্র সমালোচনা করা হয়।
আইনটির ৫৪ ধারা কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির অনিষ্ট সাধন সংক্রান্ত; ৫৬ ধারা কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিংয়ের অপরাধ সংক্রান্ত; ৫৭ ধারা ইলেকট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশের অপরাধ সংক্রান্ত এবং ৬১ ধারা সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশের অপরাধ সংক্রান্ত।
মূল আইনের ৭৬ ধারায় সংশোধনী এনে উপরোক্ত ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলো আমলযোগ্য অর্থাৎ এসব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক করতে পারবে এবং এসব অপরাধকে অ-জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এ ধারায় অনুচ্ছেদ (২) প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে, (ক) ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১- এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হবে এবং (খ) ৫৫, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ৬৫- এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হবে।
আইনটির ৫৭ ধারা অবলোকনে প্রতীয়মান হয় ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃংখলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এ কার্য হবে একটি অপরাধ।
কম্পিউটার বিষয়ে যাদের বিশেষ জ্ঞান আছে তারা নিশ্চয়ই অবগত যে, কম্পিউটারে একজন প্রকৃত ব্যক্তির নামে তার অজ্ঞাতে সহজেই ফেসবুক আইডি খোলা যায় এবং সেই ফেসবুক আইডিতে তথ্য বা ছবি আপলোড করা যায়। এমনও দেখা যায়, প্রকৃত ব্যক্তির অজান্তে তার নামে খোলা ভুয়া ফেসবুক আইডিতে অবমাননাকর সংবাদ ও অশ্লীল ছবি প্রকাশ করে তার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও এসব বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা বা সংশ্লেষ ছিল না। এমন একটি ঘটনায় যদি পুলিশ ৫৭ ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আটকপূর্বক আদালতে সোপর্দ পরবর্তী মেজিস্ট্রেট কর্তৃক অপরাধটি অ-জামিনযোগ্য বিধায় জামিন অগ্রাহ্য করার কারণে তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধ না করা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তিকে কিছুদিন কারাবাসে থাকতে হয়, সেক্ষেত্রে তার প্রতি এ অন্যায়ের প্রতিবিধান কোথায়?
অনুরূপভাবে ৫৪, ৫৬ ও ৬১ ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তকালীন পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আটকপূর্বক আদালতে সোপর্দ পরবর্তী অপরাধগুলো অ-জামিনযোগ্য হওয়ায় জামিন অগ্রাহ্যের কারণে অহেতুক কারাবাসের যে কারণ ঘটবে, তার প্রতিকারের ব্যবস্থা কী?
দেশবাসী নিশ্চয়ই অবগত, কম্পিউটার প্রযুক্তিকে অবলম্বন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দুটি মামলায় স্কাইপ কেলেংকারি ও রায় ফাঁস কেলেংকারির যে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, এর প্রথমোক্তটির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের তদন্তপূর্বক দোষীদের চিহ্নিতকরণের বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। আর দ্বিতীয়টির তদন্ত বিষয়ে দেশের দুটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তাতে অনুমিত হয় সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারার অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য করায় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে আর নিরীহ, নির্দোষ ও শান্তিপ্রিয়দের অহেতুক হয়রানির শিকার হতে হবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারার অপরাধগুলো বিশেষায়িত প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে কোনো নিরীহ, নির্দোষ ও শান্তিপ্রিয় লোকের অহেতুক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে হয়রানির সম্মুখীন হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। অতএব, আইনটির ৭৬ ধারাটি সংশোধনী পূর্ববর্তী যে অবস্থায় ছিল এবং অপর চারটি ধারার আগের সাজার পরিমাণ বহাল এবং অ-আমলযোগ্যতা অক্ষুণœ রাখা হলে সার্বিক বিবেচনায় প্রতীয়মান হয়, এর ফলে ন্যায়পরতা সমুন্নত হবে। তাই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আইনটিকে সংশোধন পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হলেই কেবল নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত হবে, অন্যথায় হরণের কারণ উদ্ভবের আশংকা থেকেই যায়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.