অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা by ধীরাজ কুমার নাথ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা জাতীয় সরকার- যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের সময়কালে আমলাতন্ত্রই সরকার পরিচালনায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে পরবর্তী জাতীয় সংসদের নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করে জনগণের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় দায়িত্ব পালন করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। যদিও বর্তমান সরকারের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হয়নি, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ১২৩ ধারা অনুসারে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তাই বর্তমানে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এ ছাড়াও সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে কখন প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে। এই যে ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার, তার প্রধান কাজ হচ্ছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা। এ লক্ষ্যে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সব দল ও জনগণের দাবি এবং এ প্রশ্নেই বিভিন্ন দলের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাহায্য-সহায়তায় সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন করবে। এরূপ কার্যাবলি সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছাড়া তারা কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনমুখী এবং কোনো ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে সংবিধান ও প্রচলিত বিধি-বিধানবিরোধী। এমনকি নির্বাচন প্রচার কাজে নিয়োজিত থাকা সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনের জন্য সরকারি যানবাহনও ব্যবহার করতে পারেন না। নিজস্ব নির্বাচনী প্রচারে সরকারি হেলিকপ্টার ব্যবহারের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল এবং তার একান্ত সচিব, যিনি ভারতীয় প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, তাকে এজন্য শাস্তি পেতে হয়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এটাই যে, তারা রাজনীতিকদের আইনের বিধান স্মরণ করিয়ে দেবেন। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা হলে তাদের শাস্তি পেতে হবে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তদারকিতে কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশবাসী তার ফলাফল গ্রহণ করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব বহুলাংশে বেড়ে যায়। প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নিরপেক্ষতার নিদর্শন স্থাপন ও তা দৃশ্যমান করা এবং একই সঙ্গে সমান সুযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সব দল ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করা। নির্বাচন কমিশনের কর্মীবাহিনীর এ কাজ প্রাথমিক দায়িত্ব হলেও অন্য সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসক (রিটার্নিং অফিসার), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনের প্রায় সব স্তরের কর্মী বাহিনী, শিক্ষক ও অন্য প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা এবং কমিশনের নির্দেশনা প্রতিপালনে নিয়োজিত থাকে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে- তা এক বড় প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ। তাদের ভূমিকা এমন হওয়া উচিত যা গণতন্ত্রের প্রেরণাকে সমুন্নত রাখতে সহায়ক হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তিকে বিকশিত করে প্রশাসনকে জনগণের কাছে সম্মানজনক অবস্থানে উন্নীত করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করার লক্ষ্যে আমলাতন্ত্রের কর্তব্য হচ্ছে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা, সুশাসনের মাধ্যমে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং সব ক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিত করা।
অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কমকর্তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়, উদাহরণস্বরূপ যিনি রাজশাহী বিভাগে আছেন তাকে চট্টগ্রাম বিভাগে এবং যিনি সিলেট বিভাগে কর্মরত তাকে খুলনা বিভাগে বদলি করা হয়, যাতে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সংসদ সদস্য অনেক দিনের পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। তবে নিজের জেলায় বা পার্শ্ববর্তী জেলায় বদলি করা যাবে না। একই সঙ্গে সব পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলি করা হয়। এমন নীতি অনুসরণ করা হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে (যদিও ২০০৬ সালে নির্বাচন হয়নি)। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরও অনুরূপভাবে বদলি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন প্রজাতন্ত্রের অধীন যে কোনো কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে বদলি, প্রত্যাহার বা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারে এবং নতুন করে দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে।
এ ছাড়াও নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ বা সংক্ষিপ্তভাবে অবহিতকরণের লক্ষ্যে প্রদর্শনীমূলক ভোট কেন্দ্রের আয়োজন করে ভোটারদের প্রশিক্ষিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ একটি অন্যতম দায়িত্ব। এ কাজে নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহায়তা দেবে প্রশাসন। ভোটারদের অবহিত করা এবং ভোটদান পদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করাও আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব।
নির্বাচনে আইন-শৃংখলার সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আইন-শৃংখলা রক্ষার মাঝেই জনপ্রশাসনের ভূমিকা অধিকতর দৃশ্যমান হয়ে থাকে। সঠিকভাবে আইন-শৃংখলা রক্ষা হচ্ছে সত্যিকার নিরপেক্ষতা ও আমলাতন্ত্রের দক্ষতার প্রতীক। কারণ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মারামারি-হানাহানি ছাড়াও জাল ভোট প্রদান, ভোটের বাক্স ছিনতাই, ভোট গণনায় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলভ্রান্তি করা, ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতিতে বাধাদানসহ সব ধরনের ঘটনা প্রবাহ, যার বিরুদ্ধে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ আকারে মামলা হতে পারে। অনেক সময় নির্বাচন-পরবর্তীকালে বা ফলাফল ঘোষণার পরও অনেক হানাহানি হতে পারে, যার প্রতি দৃষ্টি রাখা আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব।
২০০১ সালে বরিশালের আগৈলঝরা ও রামশীল এলাকায় নির্বাচন-পরবর্তী যেসব ঘটনা দেশবাসী অবলোকন করেছে এবং জাতির বিবেককে যা অদ্যাবধি দংশন করছে, তার দায়দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত আমলাতন্ত্র উপেক্ষা করতে পারে না। আগামী দিনগুলোতেও অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরই এর দায় বহন করতে হবে।
মিরপুর ও মাগুরার উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এবং এ ব্যাপারে দায়দায়িত্ব সেখানকার মাঠপর্যায়ের আমলাতন্ত্র বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উপেক্ষা করবে কীভাবে? বর্তমানে গণমাধ্যম জনগণের কাছে তুলে ধরছে জনপ্রশাসনের দুর্বলতা বা অতিরিক্ত উৎসাহের চিত্র অথবা পক্ষপাতিত্বের পরিচয় বহনকারী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। তাই আমলাতন্ত্রের জন্য দিনের পর দিন চ্যালেঞ্জ বাড়ছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালের দায়দায়িত্ব ও অভিযোগ অধিকতর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে এবং সততার পরিচয় দিতে হবে পদে পদে।
বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র অন্যতম গ্রহণযোগ্য সরকার পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনায় একমাত্র রীতি হিসেবে জনগণের মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছে- সেসব দেশে লক্ষণীয় যে, আমলাতন্ত্র গণতন্ত্র রক্ষায় অমূল্য অবদান রাখতে পেরেছে এবং তার ফলেই গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল রাখার স্বার্থে আমলাতন্ত্রকেই অধিকতর অবদান রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা অধিক নিরাপদ এবং আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালা প্রণয়নে অনেক সুযোগ পেয়ে থাকে। তাই প্রয়োজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা, যা নির্বাচনকালেই দৃশ্যমান করা সম্ভব। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনগণ প্রত্যাশা করে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোনো বিশেষ দলের তল্পিবাহক হবে না। তারা নিরপেক্ষতা, সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত দেশ ও জনগণের সেবক।
জনগণ আশা করে, আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে জাতির সামনে সুবিচার ও সুশাসনের উদাহরণ সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে তারা দেশবাসীকে টেকসই ও সত্যিকারের গণতন্ত্র উপহার দিতে সক্ষম হবে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দেশের সবার, কোনো দলের নয়। আমলাতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে, নিজেদের সুবিধা প্রাপ্তির প্রয়োজনে নয়। পদোন্নতি সাময়িক, অপবাদ চিরকালের।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.