নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া নয়

গত ২০ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিকার নেই!’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়লাম। লেখাটির জন্য পত্রিকার ‘বিশেষ প্রতিনিধি’কে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই প্রথম আলো সম্পাদককেও। কারণ, বহুল পঠিত এই পত্রিকা প্রায় নিয়মিতভাবে দেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীর দুর্ভাগ্যের তথ্যাদি এবং তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করে থাকে। উদ্দেশ্য, জাতির বিবেককে জাগ্রত করা। কিন্তু সুশীল সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের হূদয় নিংড়ানো আর্তিগুলো আজ ‘অরণ্যে রোদনে’ পর্যবসিত। দেশের সিংহভাগ মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের বাইরে আর ভাবে না। প্রতিবেদকের মতো আমরাও বিশ্বাস করি, অন্যায়-নিপীড়নের প্রতিকারের প্রত্যাশা নিপীড়িত মানুষ আর করতে সাহস পান না: ‘এ ধরনের হামলা, নির্যাতন তাঁরা নিয়তি হিসেবেই ধরে নিয়েছেন।’ (প্রথম আলো, পৃ. ৩) এ দেশের সংখ্যালঘুদের অপরাধ কী? বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মগ্রহণই কি তাদের অপরাধ?
নাকি আওয়ামী লীগে তারা ভোট দেয় বলে দোষী? যদি দ্বিতীয়টিই কারণ হয়, তবে আমার বক্তব্য এই যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের কাছে ‘মন্দের ভালো’। উপায় নেই, তাই আওয়ামী লীগকে তারা ভোট দেয়। কারণ, পরিষ্কার—এই দল ছাড়া অন্য কোনো দল সংখ্যালঘুর স্বার্থ নিয়ে ভাবে না। এমনকি তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রেও সংখ্যালঘুদের প্রবেশের সুযোগ খুব একটা নেই—যদি কেউ শুধু তার ব্যক্তিস্বার্থের কথা না ভাবে। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা তা ভালো করেই বোঝেন, তাই দলীয় আদর্শ তাঁদের মনে-আচরণে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান পায় না। তাই রক্ষক ক্ষেত্রবিশেষে ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়—অসহায় সংখ্যালঘু মানুষগুলো অবাক বিস্ময়ে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাধারণ মানুষ তো দলের নীতিনির্ধারকদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পায় না। তাই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে ৩৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে এ দেশে হিন্দুর সংখ্যা কমে ৮ দশমিক শূন্য ২-এ এসে দাঁড়িয়েছে। যে দেশে মোট জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে, সে দেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা না বেড়ে কমে যাওয়ার কারণ কী? এ প্রসঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের জনৈক সাংসদের রসাত্মক ব্যাখ্যা আমরা প্রথম আলোতে দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের প্রজননক্ষমতা কম।’
আশা করি, প্রথম আলোর পাঠকদেরও কাণ্ডজ্ঞানহীন ওই ব্যাখ্যার কথা মনে আছে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এ দেশের সংসদ অধিবেশন চলাকালে আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ কণ্ঠের প্রতিবাদ ও তার উত্তরে এক দুর্ভাগ্যজনক উক্তি আজ প্রসঙ্গত আমাদের মনে পড়ে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, ছিল বিরোধী দল হিসেবে। ভারতে বাবরি মসজিদ ধর্মান্ধ হিন্দুদের দ্বারা ধ্বংস হওয়ায় এ দেশে ভোলা জেলায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে এবং একাধিক হিন্দু নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে গর্ভ ধারণ করেন। এই অমানবিক ঘটনার পর যখন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সাংসদ তোফায়েল আহমেদ প্রতিবাদ জানান, তার উত্তরে তদানীন্তন সরকারি দলের জনৈক সাংসদ রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘তাহলে বলতে হবে, হিন্দু নারীদের গর্ভ খুব উর্বর।’ বেশ কটি কাগজে মানুষ ওই খবর পড়েছে। তোফায়েল আহমেদের দেওয়া তথ্যটির পেছনে কোনো সত্যতা ছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখারও প্রয়োজন বোধ করেনি তদানীন্তন সরকার। তখন কাগজে পড়েছি, ওই পাশবিক ঘটনার পর ভোলা থেকে নৌপথে বেশ কিছুসংখ্যক হিন্দু ভারতে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দুর ওপর নির্যাতন শুরু হয়। অতঃপর ২০০১ সালে, ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রশাসনের নাকের ডগায় চট্টগ্রাম মহানগর, হাটহাজারী, সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, রাঙামাটি, কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে (প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর, পৃ. ৩)।
তা ছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত ১৬৮টি মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং শত শত হিন্দু পরিবার হিংসাত্মক আক্রমণে সর্বস্বান্ত হয়। সরকার ও প্রশাসনকে এ ব্যাপারে অনেকটাই নিরুদ্বেগ ও অসহায় বলে মনে হয়। পরিশেষে আমার বক্তব্য এই যে, নিয়তির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এ দেশের সংখ্যালঘুদের আর কোথাও যাওয়ার স্থান নেই। দুটো বিকল্প তাদের জন্য এখনো খোলা আছে: (১) বিশ্বে অনেক আন্তর্জাতিক বিচারালয় আছে—সংখ্যালঘুদের উচিত এসব আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। (২) নির্বাচনের আগে সেকশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের দাবি উত্থাপন ও বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন শুরু করা। উল্লেখ্য, যুগপৎ উভয় বিকল্প নিয়েই ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ’ এগিয়ে যেতে পারে। সংসদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবি জাতীয় ঐক্যের অনুকূলে নয়, এ কথা সত্য। তবে ঐক্য নষ্ট হয় তখনই,
যখন কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গণতন্ত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করে। তাই বলা হয়: ডেমোক্রেসি ইজ অ্যান ইগালিটারিয়ান কনসেপ্ট। অতএব, একাধিক ধর্মের মানুষ যে দেশে বসবাস করে, সে দেশে শুধু একটি রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শটির পরিপন্থীই নয়, তা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থীও বটে। এরূপ ক্ষেত্রে সংসদে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব একটি প্রতিষেধক মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জন ক্যালহাউনের মতে, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানুষ বহুধা বিভক্ত, সে দেশে সংসদে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিত্বের বিকল্প নেই। সুইডেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা উপরিউক্ত বিকল্প দুটির কোনটি অনুসরণ করবেন, তা তাঁদেরই বিবেচনার বিষয়।
ড. জিতেন্দ্র নাথ সরকার: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.