কী হবে? কী হতে পারে?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজপথে রণসাজে পুলিশ
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্ন এখন ‘কেমন আছেন?’ অথবা ‘কী করছেন’-জাতীয় ব্যক্তিগত খোঁজখবর নয়, এখন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে প্রথমেই এই জিজ্ঞাসা—‘কী হবে?’ আরেকটু বিস্তৃত করে বললে, ‘২৫ অক্টোবরের পর কী হবে?’ প্রশ্নটি সবার মুখে, কারণ উত্তরটি কারও জানা নেই, অথচ এই উত্তরের ওপর নির্ভর করছে দেশের স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা এবং উন্নয়ন, একুশ শতকের পথে এগিয়ে চলা অর্থাৎ দেশটির ভবিষ্যৎ। পুরাকালে মানুষজন এ রকম উত্তর-অসাধ্য প্রশ্নের সামনে পড়লে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাদের কাছে দৌড়াত। স্কুলে পড়েছি গ্রিসের ডেলফির সেই বিখ্যাত ওরাকলের কথা, মিসরের স্ফিংসের কথা। অথবা গাছের পাতায় অথবা ক্রিস্টাল-গোলকে ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া পরা-মানুষদের কথা। পুরাকাল সেই কবেই গত হয়েছে, এখন রকেট-বিজ্ঞান আর ন্যানো প্রযুক্তির যুগ। ওরাকল এখন কম্পিউটারের সফটওয়্যার। কিন্তু ২৫ অক্টোবরের পর বাংলাদেশে কী হতে পারে, তা বলে দেওয়ার সাধ্য সবচেয়ে উন্নত কম্পিউটারেরও যে নেই! পুরাকালের কথা উল্লেখ করেছি—যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা ভূতের মতো ক্রমাগত পেছনে যাচ্ছি, সেই পুরাকালের দিকেই।
তা না হলে কুড়ি-বাইশ বছরের গণতন্ত্রচর্চার পর একটা বৈধ নির্বাচন সময়মতো অথবা আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে জাতীয়ভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পীড়িত হতে হবে কেন? আগামী দু-এক দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চিত করেই বলে দেবে, কী হবে অথবা কী হতে পারে। দেশের মানুষ প্রশ্ন দুটি করছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন করার পেছনে প্রথমে যে কৌতূহল, তারপর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল—এখনো আছে—সেসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রোধ। মানুষ সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। মানুষ সংঘাত চায় না, হানাহানি চায় না, হরতাল চায় না, জ্বালাও-পোড়াও, রক্তারক্তি, খুন-জখম চায় না। মানুষ চায় একটা সুন্দর নির্বাচন হোক, ভোটের দিন উৎসব হোক, জয়ী-পরাজিতরা করমর্দন করুক, নির্বাচিত সরকার প্রথম দিন থেকেই দেশটাকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করুক। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই সে রকম চাওয়া থাকে মানুষের এবং চাওয়া অনুপাতে পাওয়াও তাদের জুটে যায়। আমরাই শুধু চেয়ে যাই, পাই না। অথচ এ দেশের মানুষের এ রকম পাওয়ার প্রস্তুতি, যোগ্যতা এবং অধিকার রয়েছে। ২৫ অক্টোবর সকালে বসে এই লেখা লিখছি। বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ক্রিকেট খেলা চলছে। আসলে খেলছে তিনটি দল। তৃতীয় দলটি বৃষ্টি।
আজ খেলাটা সেই দলের অধিকারে চলে গেছে। ফলে কোনো দলের জয়ের সম্ভাবনা আর নেই। আমাদের দেশেও রাজনীতির খেলা হয় তিন দলে—সরকারি দল বা জোট, বিরোধী দল বা জোট এবং আমাদের তিক্ত, ক্লিষ্ট, পথভ্রষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই তৃতীয় দলের জন্য আমরা কিছুতেই জিততে পারি না, শুধু হারি। এই সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য নিয়মগুলো হচ্ছে আলোচনার পরিবর্তে সংঘাত, সৌজন্যের পরিবর্তে শত্রুতা, যুক্তির পরিবর্তে গলাবাজি। নিয়মের মধ্যে আরও আছে একে অপরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা, কটু কথা এবং গালিগালাজের (এবং সময় সময় অশ্লীল কথাবার্তা) অকাতর প্রয়োগ। এই সংস্কৃতি তৈরি করে বিভাজন। ফলে এখন পেশাজীবীরা, বুদ্ধিজীবীরা, বিদ্যাজীবীরা সবাই দল/জোটের বিভাজন রেখা ধরে বিরোধী দুই শিবিরে ঢুকে পড়েছেন। দুর্নীতি এই সংস্কৃতির এক বড় চালিকাশক্তি। এখন দুর্নীতিবাজদের সমীহর চোখে দেখা হয়। তারা দলগুলোর অর্থায়নের বড় উৎস। তাদের সমীহ না করলে দল চলবে কেমন করে? কিন্তু এই পেছনে নিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির তো অবসান চাই। তা না হলে দেশটা পড়বে এক বিশাল খাদে, যেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো হবে প্রায় অসম্ভব। মনে রাখতে হবে, এ দেশে দুই-চার কোটি নয়, ষোলো-সতেরো কোটি মানুষের বাস। মিয়ানমার আয়তনে আমাদের আট গুণ, জনসংখ্যা আমাদের চার ভাগের এক ভাগ।
দেশটি যেভাবে উঠে দাঁড়াচ্ছে, তাতে আরও দশ বছর পর আমাদের ধনাঢ্যরা ইয়াঙ্গুনে বাজার-ভ্রমণে যাবেন; অথবা অবকাশযাপনে। ষোলো-সতেরো কোটি মানুষের দেশে বিরাট কোনো বিপর্যয় নামলে দিনের পর দিন বিশ্ব মিডিয়ায় আমরা শুধু খারাপ সংবাদ হয়েই থাকব, রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর যেমন ছিলাম। আমরা খারাপ সংবাদের শিরোনাম হতে চাই না। বৃহস্পতিবার মিরপুর স্টেডিয়ামে যখন মোমিনুল নামের ছোটখাটো ছেলেটি অনিন্দ্যসুন্দর খেলা খেলে শতরান করল, আমি তখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনের কাছে ছিলাম। শিক্ষার্থীদের চিৎকারে সারা দালান বুঝি ভেঙে পড়ছিল। সেই সময় কেউ যদি টেলিভিশনের চ্যানেল বদল করে মির্জা ফখরুল অথবা সৈয়দ আশরাফ ২৫ অক্টোবর নিয়ে কী বলছেন, তা দেখতে ও শুনতে চাইত, তাকে নির্ঘাত সেখান থেকে বের করে দেওয়া হতো। এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চেয়ে আমাদের ক্রোধটাই বেশি। দেশটাকে নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা কেন করা হচ্ছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের রশি ধরে বসে আছেন, মাননীয় বিরোধী নেত্রী বসে আছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রশি হাতে। প্রধানমন্ত্রী বেতার-টিভিতে বক্তৃতা দিলেন। একটুখানি সরে এলেন তাঁর ‘একচুলও নড়ব না’ অবস্থান থেকে।
কিন্তু বিশদ করে বললেন না, নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান কে হতে পারেন। তিনি প্রধান থাকলে তো বিরোধীরা নির্বাচনে যাবে না, এমনকি তাঁর জোটে আজ-আছি-কাল-নেই সেই জাতীয় পার্টিও। তার পরও এটি ছিল প্রস্তাব হিসেবে মন্দের ভালো, অন্তত একটা আলোচনা চলতে পারত। কিন্তু এর পরপরই বেগম জিয়া দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক ফর্মুলা। এই ফর্মুলায় যাঁদের থেকে উপদেষ্টা নেওয়ার কথা, তাঁদের কেউ কেউ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, কেউ কেউ তাঁদের অপারগতা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করা হয়নি। বেগম জিয়া তাঁর হাত থেকে তত্ত্বাবধায়কের রশিটা একটুখানি আলগা করেননি। যদি তিনি হালনাগাদ একটা চিন্তা উপহার দিতেন, একটা মন্দের ভালো প্রস্তাবও দিতেন, একটা আলোচনা হতো। জাতীয় সংসদে যখন বিরোধী দল গেল, তাদের ওপর সরকারদলীয়রা চড়াও হলেন। যেখানে একটু বাতাস দিলেই চাল উড়ে যায়, সেখানে ছোটখাটো একটা ঝড়ের দেখা পেলেন বিরোধী সাংসদেরা। তাঁরা মনের আনন্দে বাইরের দরজার দিকে হাঁটা দিলেন। ‘বিধি মোতাবেক প্রস্তাব তুলুন’—এ রকম তাঁদের বললেন সরকারদলীয়রা। কিন্তু যাঁরা বললেন, তাঁরা কটা বিধি মানেন, আর যাঁদের উদ্দেশে তা বলা হলো, তাঁরাই বা কটা মানেন, বলুন? বিধি তো সেই একটাই—আমাদের কপালের লিখন। সেই বিধি চিরদিনই যেন বাম।
ফলে অবস্থার কোনো ইতরবিশেষ হলো না। আজ কাগজে দেখলাম, বেগম জিয়া বলেছেন, এই সরকার অবৈধ। এরপর সরকার নিশ্চয় চাইবে তার বৈধতা কী এবং কত প্রকার তা দেখাতে। ফলে ‘কী হতে পারে’ প্রশ্নটির একটি ভীতিকর উত্তরের আশঙ্কাই দেখা যাচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী। আশাবাদী না হয়ে তো উপায় নেই। আমি প্রতিদিন কাটাই তরুণদের সান্নিধ্যে, তারাই আমাকে আশাবাদী করে। এদের পরিবর্তে যদি আমার দিন কাটত মতলববাজ আর দুর্নীতিবাজ লোক, উগ্রবাদী এবং জঙ্গিদের সঙ্গে, তাহলে আমিও হতাশায় ভুগতাম। একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে, সরকারের ‘সভা করতে দেব না’ থেকে ‘শর্ত সাপেক্ষে সভা করা যাবে’ অবস্থান পরিবর্তনের মধ্যে। জঙ্গিরা যদি জুমার নামাজের পর বোমা-ককটেল নিয়ে রাস্তায় না নামে, জাতীয়তাবাদীরা যদি দা-কুড়াল-বল্লম নিয়ে অথবা আওয়ামী-সমর্থকেরা যদি লগি-বইঠা নিয়ে রাস্তায় না বেরোয়, তাহলে হয়তো রক্তপাত ইত্যাদি এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সত্যিকার উদ্যোগ না নিলে হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও দেশ অচল করার কর্মসূচি ঠেকানো যাবে না। মানুষ ক্রোধ নিয়েই এখন কথা বলছে এবং মানুষের কথা দুই জোটকে শুনতে হবে। মানুষ নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি দেখে দেখে ক্লান্ত। মানুষ চায় শান্তি। ফলে এখন দুই জোটকে সংলাপে বসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যে টেলিফোন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বিরোধী নেত্রীকে, দু-এক দিনের মধ্যে তিনি যেন তা করেন এবং সেই টেলিফোন পেয়ে বিরোধী নেত্রী যেন বলেন, কথাবার্তা শুরু করা যাক। পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নেই, যেখানে জনগণ ক্রমাগত নিজেদের জীবন উন্নত করার সংগ্রাম করে যাচ্ছে আর রাজনীতিবিদেরা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের পথে। পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নেই, যেখানে কুড়ি বছর মোটামুটি নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চললেও প্রধান দুই দলের নেতার মধ্যে কোনো কথাবার্তা অথবা সৌজন্য বিনিময় হয় না। একটি দেশেই—এই হতভাগা দেশেই—আছে এমন অচর্চা। এর থেকে বেরোতে হবে। ‘কী হবে?’ এর উত্তরে আমি বলব, তিতিবিরক্ত মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠবে। ‘কী হতে পারে’র উত্তরে বলব, আমাদের অপরাজনীতির চর্চা, উগ্রবাদ, মধ্য যুগে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা—এসবকে মানুষ রুখে দেবে। দেবে যে আমি নিশ্চিত—আগামী কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহে যা-ই ঘটুক না কেন, অথবা দুই জোট সেসব ঘটানোর জন্য যত প্রাণপাত পরিশ্রমই করুক না কেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.