এবার খালেদা জিয়ার এক দফা

গত মাসে একটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে নির্ধারিত অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের পার্লামেন্ট ভবন পরিদর্শন এবং পার্লামেন্ট স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং ব্যুরোর উপদেষ্টা ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান রাশিদ আলভির সঙ্গে মতবিনিময়। তিনি পার্লামেন্ট ভবনের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি ভারতীয় পার্লামেন্ট কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে একই সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ও মোরারজি দেশাইয়ের ছবি শোভা পাচ্ছে। আছে গান্ধী-নেহরুর সঙ্গে নেতাজি সুভাষ বসুর ভাস্কর্যও। কিন্তু বাংলাদেশে পরস্পরবিরোধী মতের নেতাদের ছবি ও ভাস্কর্য একসঙ্গে স্থাপনের নজির নেই। বরং ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা থেকে নামফলক ও ছবি নামানো-ওঠানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমাদের রাজনীতিকেরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করেন না। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাশিদ আলভি বলেন, গত ৬৭ বছরে দেশটি নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসেছে। কিন্তু এক দিনের জন্যও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি। এটাই ভারতের গণতন্ত্রের শক্তি ও সৌন্দর্য।
সবশেষে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বললেন তা হলো, একটি দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, তার প্রধান মাপকাঠি হলো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। তাঁর এই কথায় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক-বন্ধুরা পরস্পরের দিকে তাকান এবং নিজেদের প্রশ্ন করেন, তাহলে কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই? সেনাবাহিনী বুটের জোরে বাংলাদেশে দুবার ক্ষমতা নিয়েছে, সে কথা আমরা জোর গলায় বলি। ২০০৭ সালে তারা ক্ষমতা দখল করলেও মঞ্চের আড়ালে ছিল। কিন্তু সেনাশাসনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা বাদ দিলেও আমাদের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ পর্যন্ত একটিবারের জন্যও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই দাবি করেন, ২০০১ সালে তাঁর সরকারই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। কার কাছে? লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। কিন্তু সেই হস্তান্তরও পুরো শান্তিপূর্ণ ছিল না। ১৫ জুলাইতে বঙ্গভবনে আয়োজিত ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে কি তৎকালীন বিরোধী দলের নেতারা গিয়েছিলেন? যাননি। কেন যাননি? বঙ্গভবনে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল দুপুরে। সে অনুযায়ী সবাইকে আমন্ত্রণপত্রও পাঠানো হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোঁ ধরলেন, বিকেলে প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা করেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, তার আগে নয়। এরপর বঙ্গভবন সময়সূচি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
এই সিদ্ধান্তে বিএনপি ক্ষুব্ধ হয়ে সন্ধ্যার ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যায়নি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাত্যাগী ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল দুটির নেতা-কর্মীরা মারামারিতে লিপ্ত হলেন। পাল্টাপাল্টি হামলা চলল। এই হলো আমাদের একমাত্র ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ নমুনা। আর ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ, ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় দেশে কী ঘটেছিল, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এখন আমরা আরেক অক্টোবরের মুখোমুখি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল লগি-বইঠার আন্দোলন। এবার দা-কুড়াল-বল্লমের রণধ্বনি শুনতে পেলাম। সারা দেশে টান টান উত্তেজনা। গতকাল ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় সরকারের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে না পড়লেও বিভিন্ন স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ককটেল-বোমা ফাটছে। আটক-গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। গুলি-সংঘর্ষে কয়েকজন মারা গেছে। বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া ২৭ অক্টোবর থেকে টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছেন। এটা নাকি তাঁর প্রাথমিক কর্মসূচি। সামনে আরও কঠোর কর্মসূচি আসছে। তাহলে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনগণের জীবন-জীবিকার কী হবে? ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা-পরীক্ষা? গোটা জাতি জিম্মি হয়ে পড়ল একটি নির্বাচনের জন্য। সরকার ও বিরোধী দল যে যার অবস্থানে অনড়।
কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা এক দফার আন্দোলন করেছিলেন—খালেদার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এখন খালেদা জিয়া আবার এক দফার আন্দোলন করছেন—শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, সংবিধানের ভেতরেও সমাধান সম্ভব। কীভাবে? যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং বাকি ৩৪৪ সাংসদের মধ্য থেকে আরেকজন সেই দায়িত্ব নেন। সেই ত্যাগস্বীকারে কি শেখ হাসিনা রাজি আছেন? ১৯৯৫-৯৬ সালে খালেদা জিয়া রাজি ছিলেন না বলে ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা ও একদলীয় নির্বাচন হয়েছে। বাকশাল কেবল আওয়ামী লীগই করেনি, যত কম দিনের জন্য হোক না কেন, খালেদা জিয়াও একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। এখন কী হবে? যদি শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে আস্থায় এনে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে পারেন, দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। আর যদি না পারেন কিংবা বিরোধী দল কোনো শর্তেই রাজি না হয়, তাহলে কী হবে? চারদিকে অন্ধকার দেখছি। বিরোধী দলের নেতা খালেদা
জিয়া ইতিমধ্যে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকার ২৪ অক্টোবর (গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া ভাষণে বলেছেন ২৭ অক্টোবর) থেকে অবৈধ এবং তিনি অবৈধ সরকারের পতন ঘটাতে দলীয় নেতা-কর্মী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের যেখানেই পাওয়া যাবে, তাদের প্রতিরোধ করা হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে ন্যস্ত করা হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের হুঁশিয়ারি, বিরোধী দল সমাবেশের নামে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে আওয়ামী লীগ তা শক্ত হাতে প্রতিহত করবে। অপর যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক জামায়াত-শিবিরের নাশকতা সম্পর্কে তাঁর কাছে খবর আছে, এই তথ্য জানিয়ে দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘জুমার পর দেশকে যেন তারা রক্তাক্ত আফগানিস্তানে পরিণত করতে না পারে, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।’ দলীয় নেতা-কর্মীরা কতটা সজাগ ছিলেন, জানি না। তবে জনগণ ভয়ে আছে, আতঙ্কে আছে। নেতারা পাঁচ বছর পর একটি নির্বাচন করবেন এবং জনগণকে ভয়ভীতি ও শঙ্কার মুখে রাখবেন। এটাই জনগণের প্রতি নেতাদের বড় উপহার। আজ আওয়ামী লীগের ও বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির সঙ্গে ২০০৬ সালের বক্তৃতা-বিবৃতি মিলিয়ে দেখুন।
সে সময়ে বিএনপির নেতারা যেভাবে সংবিধান সমুন্নত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন, আজ আওয়ামী লীগের নেতারাও তা-ই করছেন। আবার সে সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা জনগণের নামে যা যা বলতেন, এখন বিএনপির নেতারা ঠিক তা-ই বলছেন। নাটকের কুশীলব বদলায়নি, ভূমিকা বদলেছে মাত্র। আক্ষেপ হলো, ক্ষমতাসীন দলটি বিরোধী দলের কথিত নাশকতা ঠেকাতে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা করতে পারছে না। তারা দলীয় কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছে। দেশের জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। আর অন্য পক্ষ আগে থেকেই মাঠে আছে। যদি এভাবে দুই পক্ষই মাঠে শক্তির পরীক্ষায় লিপ্ত হয়, তাহলে নির্বাচনের প্রয়োজনটা কী? এত অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করে প্রচারণারও দরকার নেই। বলে দিন, পাঁচ বছর পর পর মাঠের শক্তিপরীক্ষায় যে জয়ী হবে, সে-ই ক্ষমতায় যাবে। মধ্যযুগে মল্লযুদ্ধ হতো। ৪২ বছর ধরে আমাদের দেশেও ক্ষমতা নিয়ে একধরনের মল্লযুদ্ধ চলছে। মাঠে শক্তিপরীক্ষা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। আমাদের প্রধান দুটি দল নির্বাচনের মূল যে নায়ক, সেই জনগণের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না বলেই মাঠে শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে। অনেক নাটকীয়তার পর শুক্রবার ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ কয়েকটি স্থানে বিরোধী দলকে জনসভা করার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পঞ্চগড়সহ অন্তত ১০টি স্থানে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। আবার কয়েকটি স্থানে বিরোধী দল সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই যে দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান, এতে জনগণের কোনো দাবি নেই, তাদের নিরাপত্তার কথা নেই এবং দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির পরিকল্পনা নেই। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও বিতর্ক নেই। কেবলই মাঠ দখল। কেবলই জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ। এই যে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দুই পক্ষ—সবকিছুই করছে গণতন্ত্রের নামে। এক পক্ষ তাদের ভাষায় স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের দাবি মানা না হলে দেশ অচল করে দেওয়া হবে। সড়ক, রেল ও নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া হবে (কিন্তু নেতা-নেত্রীদের গাড়ি চলবে কি না, সে কথা স্পষ্ট করে বলেননি)। অন্য পক্ষ জনগণ ও গণতন্ত্র রক্ষায় বিরোধী দলের সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলায় প্রস্তুত। তারা বলছে, এটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু দুই পক্ষের ক্লান্তিহীন লড়াইয়ে জনগণ যে জিম্মি হচ্ছে, দেশ যে পিছিয়ে যাচ্ছে,
সেসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সরকারি দল বলছে, আগে স্বাধীনতার শত্রুদের পরাস্ত করুন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আবার বিরোধী দলের দাবি, শেখ হাসিনার সরকারকে হটালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দেশ ও গণতন্ত্র বাঁচবে। অর্থাৎ, সবকিছুই ঘটছে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য। সেখানে নির্বাচন উপলক্ষ হলেও গণতন্ত্র লক্ষ্য হতে পারেনি। এর নাম সত্যিকার গণতন্ত্র নয়। বলপ্রয়োগের গণতন্ত্র। শক্তি প্রদর্শনের গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্র মনে স্বস্তি আনে না, ভীতি জাগায়। এই ভয়ংকর ও সর্বনাশা গণতন্ত্র থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন রাজনীতিকেরাই, অন্য কোনো শক্তি নয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। আপনারা আলোচনায় বসুন। ফোন ও চিঠির মুলো না ঝুলিয়ে এখনই আলোচনায় বসুন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন। দুজনের বা যেকোনো একজনের একগুঁয়েমি দেশকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.