ঐকমত্যের বিকল্প নেই by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার

নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে- এ বিষয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো। সরকারি দল আদালতের রায়ের অজুহাতে সংবিধান সংশোধন করে এ বিতর্কের সূত্রপাত করে। বিরোধী দলও বর্তমান সরকারের মেয়াদের প্রায় পুরোটা সময় এ ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে সরকারবিরোধী আন্দোলন জমিয়ে তোলার জন্য সরকার বহুবার বিরোধী দলের কোর্টে বল পাঠালেও বিরোধী দল কখনও ওই বলে চার-ছক্কা মারা তো দূরের কথা, দু’-এক রান নিতেই হিমশিম খেয়েছে। অথচ বিরোধী দলের হাতে ইস্যুর অভাব ছিল না। পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্কের অর্থ আত্মসাৎ, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেংকারি, গুম ও হত্যার রাজনীতি, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ মানুষ হত্যা প্রভৃতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। এর যে কোনো একটিই বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিরোধী দল এসব জাতীয় ইস্যুকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে কোনো জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। যদিও তারা দু’-একদিন এ বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে। হরতাল, মানববন্ধন, মিছিল, সভা-সমাবেশ করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই সব রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলনে পরিণত হয়। যদিও ওই আন্দোলনের আওয়াজ এতই ক্ষীণ ছিল যে তা সরকারের কর্ণকুহরে পৌঁছেনি। তাই সরকারের শেষ সময় এসেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
অতি সম্প্রতি আবারও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক জমে উঠেছে। তবে এ বিতর্ক বেশ ইতিবাচক। মনে হচ্ছে, সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজছে। যদিও এবার এর সূচনা করেছে সরকারি দল। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন এবং এ বিষয়ে বিরোধী দলের পরামর্শ চেয়েছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেননি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, অথবা তিনি নিজেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন কি-না। ফলে বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যদিও ইতিপূর্বে বলেছিলেন তিনি একচুলও নড়বেন না, এ ভাষণের মাধ্যমে এখন তিনি বহুচুল নড়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সংবিধানের মধ্যে থেকেই। তিনি নির্বাচনকালীন সরকার কী ধরনের হবে সে বিষয়ে কারও কোনো মতামত চাননি। তিনি মতামত চেয়েছেন নির্বাচনকালীন সরকারে কোন কোন সংসদ সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে। অর্থাৎ তিনি এখনও সংবিধান থেকে একচুলও নড়েননি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াও একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর সারকথা, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্য থেকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে এবং সরকারি ও বিরোধী দল থেকেই তাদের নাম প্রস্তাব করা হবে। এ প্রস্তাবও অনেকটা অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুরূপ। পার্থক্য এখানে এটুকুই যে, ইতিপূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা অনির্বাচিত ছিলেন; এখন তারা নির্বাচিত হবেন। খালেদা জিয়া তার প্রস্তাবে সংসদ সদস্যদের দ্বারা অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, স্পিকার অথবা সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্যদের মতো করে এ উপদেষ্টাদের নির্বাচিত করা যেতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সরকারি ও বিরোধী দলের এই বিপরীতধর্মী প্রস্তাবের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ চাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ওই আহ্বানে বিরোধীদলীয় নেতা সাড়া দিয়ে নতুন প্রস্তাব রেখেছেন। রাজপথে সংঘাত-সংঘর্ষ নয়, কেবল শান্তিপূর্ণ পথেই সমাধান সম্ভব- তার মধ্যে এমন উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া উভয়েই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যেমন নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতাও আগামীতে নির্বাচিত হলে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের কথা বলেছেন। বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি দলের সমালোচনা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরোধী দল সম্পর্কে সমালোচনাও বেশ মজারই বটে। তারা উভয়েই একে অপরকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের জন্য দায়ী করছেন। এ বিষয়গুলো থেকে স্পষ্ট যে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে উভয়ের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হলেও কয়েকটি বিষয়ে উভয়ের চিন্তা-চেতনা একই ধরনের। এখন পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে যদি নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে উভয়ের চিন্তা-চেতনাকে অন্য চিন্তা-চেতনার মতো একই সূত্রে গাথা যায়, তবে অচিরেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। আর এমনটি যদি হয় তা উভয় দল, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। অনিশ্চিত গণতন্ত্র নতুন দিশা পাবে। জনমনে স্বতি ফিরে আসবে। উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে।
সরকারি ও বিরোধী দলের গত কয়েক দিনের তৎপরতা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, তারা উভয়েই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতায় আগ্রহী। যদিও এখন পর্যন্ত উভয়েই নানাভাবে, ভিন্ন কৌশলে নিজেদের ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। তবে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল সদিচ্ছা। যদি সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকে, তাহলে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত হলে সমস্যার সমাধান করা কঠিন হবে না। উভয় দল যদি তাদের মনোভাব নমনীয় করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে ছাড় দেয়, তবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে নাকি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, সে বিষয়টির সমাধান অসম্ভব নয়। শেখ হাসিনা তার ভাষণে যা বলেছেন, তার সারকথাও দেশ ও জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এ স্বার্থ সংরক্ষণ করতেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন, সংবিধান সংশোধন করেছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাও তার ভাষণে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাই উভয়ে যদি সত্যিকার অর্থে দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেন, তবে উভয়েই দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে ছাড় দেবেন, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসবেন বলে আমরা আশা করি।
বর্তমান সংবিধান কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবে না। সংবিধানের জন্য দেশ বা জনগণ নয়, দেশ বা জনগণের জন্যই সংবিধান। দেশের মানুষ ও জনগণের জন্য প্রয়োজনবোধে সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। আর এ জন্য কয়েক মাস, কয়েক বছর বা কয়েক যুগ সময়ের প্রয়োজন নেই। যদি উভয় রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করে, তবে তা কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটে করা সম্ভব। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানো। যদি তারা একমত হতে পারে, তা পর্দার আড়ালেই হোক আর পর্দার বাইরে হোক, সংবিধান তাদের জন্য কখনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না, যেমন দাঁড়ায়নি ১৯৯৬-এ।
আমরা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতি চাই না। আমরা চাই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য সারাবিশ্বে কুখ্যাতি অর্জনকারী পাকিস্তানে যদি সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না? ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ পুণ্যভূমি কারও একগুঁয়েমিতে মিসর, সিরিয়া বা লিবিয়ায় পরিণত হোক, আমরা তা চাই না।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.