দক্ষতা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা

মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাতারে অনুষ্ঠিত মানি লন্ডারিং-বিষয়ক এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) এবং মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন দমনে ইউরেশীয় গ্রুপের (ইএজি) উদ্যোগে অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ শুরু হবে বিকেলের অধিবেশন থেকে। তাই সকালটা কর্মহীন বলে হোটেল ছেড়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে যাই সুখবাতার স্কয়ারে। স্কয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে মঙ্গোলীয় পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং মঙ্গোলীয় বিপ্লবের জনক হিসেবে পরিচিত দামদিন সুখবাতারের (১৮৯৩-১৯২৩) নামে। সুখবাতারের একটা অশ্বারোহী মূর্তি উঁচু বেদির ওপর বসানো স্কয়ারের দক্ষিণ পাশে। ঘোড়াটির এক পা মাটি থেকে ওঠানো। বলা হয়, যদি ঘোড়ার এক পা ওঠানো থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, ওটায় আসীন যোদ্ধাটি আহত হয়েছিল যুদ্ধে, দুই পা ওঠানো থাকলে তার আরোহী যুদ্ধে নিহত, আর চার পা মাটিতে থাকলে তার আরোহী ছিল যুদ্ধে অক্ষত। তবে মূর্তিটির এক পা ওঠানো হলেও সুখবাতার কোনো যুদ্ধাহত সেনা নন। বিশাল স্কয়ারটির উত্তর পাশে ‘সরকারি প্রাসাদ’ নামে পরিচিত দৃষ্টিনন্দন রোমান স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভবন, উলসিন ইখ খুরাল বা স্টেট গ্রেট অ্যাসেম্বলি, অর্থাৎ মঙ্গোলিয়ার পার্লামেন্ট ভবন। সামনের সিঁড়ির ঠিক মাঝ বরাবর চেঙ্গিস খানের বিশাল ভাস্কর্যমূর্তি, দুই কোনায় আরও দুটি মূর্তি ওগোদে খান ও কুবলাই খানের। ওগোদে খান হচ্ছেন চেঙ্গিস খানের তৃতীয় পুত্র, আর কুবলাই খান হচ্ছেন নাতি।
বেলা ১১টার উজ্জ্বল রোদের মধ্যে দল বেঁধে হেঁটে বেড়াচ্ছে দলে দলে তরুণ-তরুণীরা, দিনের তাপমাত্রাও ১১ ডিগ্রি। বাতাসে শীত শীত ভাব, রোদ থাকলেও হাওয়ার কারণে সে রোদ যেন শরীর থেকে পিছলে নেমে যাচ্ছে। সুখবাতারের ভাস্কর্যটার উঁচু বেদির চারপাশ দোলনার মতো ঝোলানো মোটা লোহার শিকল দিয়ে ঘেরা। সেই শিকলের ওপর বসে রোদ পোহাতে পোহাতে আড্ডা দিচ্ছে তরুণীরা। বেদির নিচের ধাপের ওপর বসা একদল বুড়োবুড়ি গল্পে মশগুল। চারপাশে বেশ একটা উৎসবের রেশ। ভাস্কর্যটার দক্ষিণ পাশের চত্বরে মেলা বসেছে, কিন্তু কিসের মেলা বোঝার উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর পর মাইকে আমাদের দেশের বার্ষিক স্পোর্টসের মতো ঘোষণার সুরে মনে হচ্ছে কোনো একটা প্রতিযোগিতা হয়তো। এক পাশে সারি সারি মঙ্গোলীয় ‘গের’ বসানো। গের হচ্ছে মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁবুর মতো ঘর। চামড়া কিংবা উল দিয়ে তৈরি গোলাকার দেয়ালের ওপর শামিয়ানার মতো মাঝখানে সরু হয়ে ওঠা ছাদ। একটিমাত্র নিচু দরজা, ছাদের মাঝ বরাবর কিছুটা অংশ দিয়ে আলো ঢোকানোর ব্যবস্থা থাকে। কারণ, গোল দেয়ালের কোথাও জানালা নেই। মেলার দিকে এগোতেই এক ঢ্যাঙামতো লোক পাকড়াও করে, আপনি সাংবাদিক, তাই না? আমি জবাব দেওয়ার আগেই লোকটি বলে, আমিও ফ্রিল্যান্সিং করি। নাম-পরিচয়ে জানা গেল লোকটির নাম ‘আমার’, হয়তো বাংলা অমর।
তারপর অবধারিত প্রশ্ন, আপনি কোথা থেকে, ইন্ডিয়া? আমি বলি, জি না, বাংলাদেশ। আমার দেশের নাম শোনার পর অমর আচমকা প্রশ্ন করে, নারী-পুরুষের সমতা কেমন আপনাদের দেশে? দুই হাত উঁচু-নিচু করে অসমতা বুঝিয়ে সে বলে, পাকিস্তানে তো এই রকম, আমি কোরিয়ায় কাজ করেছি, সেখানেও অসমতা অনেক বেশি। আমি বলি, আমার দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের তুলনা না করাই ভালো। আপনিও সাংবাদিক, খোঁজখবর করে দেখতে পারেন। অমরের অত কথা শোনার সময় নেই, বলে, চলি ভাই, ওই যে সামনে বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে, ওটা ব্লুমবার্গের অফিস, ওখানে আমার এক বন্ধু কাজ করে, দেখি আড্ডা দিতে দিতে কোনো খবর বের করা যায় কি না। লোকটি এত দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয় যে মেলাটা কী উপলক্ষে, সেটি আর জেনে নেওয়া হয় না। আমিও মেলার ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করি উপলক্ষটা। একে-ওকে জিজ্ঞেস করি, স্পিক ইংলিশ? সবারই একই জবাব, নো। একটা গের-এর দরজায় অভ্যর্থনাকারী দুই সুসজ্জিতা তরুণী দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করি, স্পিক ইংলিশ? ওরা আমার কথার জবাব না দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ‘অ্যাংলো’ বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। আমি আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করি। একজন ইয়েস বলার পর জিজ্ঞেস করি, এখানে কী হচ্ছে?
লোকটি কিছু না বুঝে লাজুক হেসে শুধু বলে, নো নো। আমারও রোখ চেপে যায়, ঘটনাটা কী বের করতেই হবে। সামনে দেখি ‘টিভি ফাইভ’-এর এক রিপোর্টার বুম হাতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যামেরার চোখ উপেক্ষা করে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ইংরেজি জানে কি না। ও ‘ইয়েস, লিটল ইংলিশ’ বললে জানতে চাই কী হচ্ছে এখানে। ও খুব কায়দা করে বলে, অ্যা ফেয়ার। বলি, ফেয়ার তো দেখতেই পাচ্ছি, কিসের ফেয়ার? সে অনেক হাতড়েও আর কোনো ইংরেজি শব্দ খুঁজে পায় না। মেলাটা কিসের তার ইংরেজি জবাব জানতে সে এদিক-ওদিক কাউকে খোঁজে। আমি বলি, ইংরেজি জানে এমন কাউকে খুঁজে বের করো। ছেলেটি ক্যামেরার সামনে থেকে বের হয়ে ইংরেজি জানা কাউকে খুঁজতে গিয়ে ভিড়ের ভেতর বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। ক্যামেরার পেছনের মেয়েটি অসহায়ের মতো এদিক-সেদিক তাকায়। বুঝতে পারি, ছেলেটি হয় জুতসই কাউকে খুঁজে বের করতে গেছে, অথবা স্রেফ কেটে পড়েছে আপাতত। টিভি ফাইভের ছেলেটি ভেগে যাওয়ার পর ইংরেজি জানা আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে একটা ঘেরা জায়গার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ঘেরার ভেতরে কয়েক দলে ভাগ হয়ে কিছু ছেলেমেয়ে মিলে আলাদা দেয়াল গাঁথছিল ইট মসলা দিয়ে।
ঘেরার পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক দর্শকদের উদ্দেশে আবারও গলা তুলে জিজ্ঞেস করি, অ্যানিবডি স্পিক ইংলিশ হিয়ার? এবার কাজ হয়, পাশ থেকে এক মঙ্গোলীয় তরুণী এগিয়ে এসে বলে, ইয়েস, আই ক্যান। এখানে মেলাটা কী উপলক্ষে জানতে চাইলে মেয়েটি খোলাসা করে বলে, ২০১৫ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হবে ‘ওয়ার্ল্ড স্কিলস কম্পিটিশন,’ অর্থাৎ বিশ্ব দক্ষতা প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় মঙ্গোলীয় প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে এখানে চলছে দেশীয় প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় দুই বছর পর পর ১৭ থেকে ২২ বছর বয়সী বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে, যাতে তারা নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে। এটির আয়োজক ওয়ার্ল্ড স্কিলস ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংস্থা। সংস্থাটির আগের নাম ছিল ইন্টারন্যাশনাল ভোকেশন ট্রেনিং অর্গানাইজেশন। সংস্থাটির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৫০। ১৯৪৬ সালে স্পেনের শ্রমিক সংস্থার তৎকালীন প্রধানের উদ্যোগে স্পেনীয় তরুণদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবী বৃত্তিজীবীদের খুঁজে বের করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই পথ ধরে ওয়ার্ল্ড স্কিলস ইন্টারন্যাশনালের যাত্রা শুরু। সংস্থাটির উদ্দেশ্য সদস্যদেশগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও দেশীয় অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য দক্ষতা এবং উচ্চমানের যোগ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। সংস্থাটির প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য ছিল এসব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ পেশাজীবীদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময় করা,
সরকার, শিক্ষা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি ঘটানো এবং তরুণ পেশাজীবীদের মধ্যে নিজ নিজ যোগ্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কেবল স্পেনীয় নাগরিকদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম প্রতিযোগিতা। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণের জন্য আন্তর্দেশীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ১৯৫০ সালে স্পেন এবং পর্তুগালের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মাদ্রিদে। এরপর ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত মাদ্রিদেই অনুষ্ঠিত হয় আরও পাঁচটি প্রতিযোগিতা। ১৯৭০ সাল থেকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিযোগিতাটি হবে দ্বিবার্ষিক। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের প্রতিযোগিতাটি হয় জার্মানির লাইপজিগে, পরেরটি ব্রাজিলে এবং ২০১৭ সালেরটি হবে আবুধাবিতে। যে মেয়েটি ইংরেজি জানে বলে এগিয়ে এসে প্রতিযোগিতার বিষয়টি খোলাসা করতে পেরেছিল, তার নাম তুমুরবাতার বোলোরমা, মঙ্গোলীয় বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান। বোলোরমার কাছ থেকে বিশ্ব দক্ষতা প্রতিযোগিতা সম্পর্কে এসব অনেক তথ্য জানা গেল। মোট ছয়টি পেশার বিভিন্ন শাখায় দক্ষতার প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়। ইমারত নির্মাণ কৌশলের শাখাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইট গাঁথা, কিংবা কাঠের কাজ থেকে শুরু করে উদ্যানতত্ত্ব এবং এয়ারকন্ডিশনিং পর্যন্ত। ক্রিয়েটিভ আর্ট ও ফ্যাশন পেশায় জুয়েলারিও অন্তর্ভুক্ত। তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে মুদ্রণশিল্পসহ সবগুলো বিষয়। উৎপাদন ও প্রকৌশল পেশায় রয়েছে ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রকৌশল থেকে ওয়েল্ডিং পর্যন্ত অনেকগুলো শাখা।
সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিষেবায় আছে রন্ধনশিল্প থেকে শুরু করে বিউটি থেরাপি, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি হেয়ার ড্রেসিং পর্যন্ত। পরিবহন এবং লজিস্টিকস বিভাগের মধ্যে গাড়ি রং করা থেকে এয়ারক্রাফট মেরামতি পর্যন্ত সবই আছে। দিনাজপুরে ওয়ার্ল্ড স্কিলস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় একটা স্যানিটেশন প্রকল্প চালু হয়েছে বলে ধারণা করা যায়, সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ কোনো অপরিচিত গন্তব্য নয়। এই সংস্থার সদস্যপদ এবং সহায়তা গ্রহণ করে বাংলাদেশ বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতায়ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা উচিত। কারণ, প্রথমত, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং কর্মসংস্থানের বাস্তবতায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা হতে পারে বেকারত্ব কমানোর এক সফল কৌশল। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে বেশি সংখ্যক দক্ষ মানবসম্পদ বের হয়ে আসার সম্ভাবনা মাত্র ২৯ লাখ জনসংখ্যা-অধ্যুষিত মঙ্গোলিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। বৈরী পরিবেশ ও প্রতিবেশে বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশের মানুষের দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাও অনেকে বেড়েছে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, এই প্রতিযোগিতায় যাতে কেবল সত্যিকার যোগ্যরাই অংশগ্রহণ করতে পারে এবং এটি যাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে পর্যবসিত না হয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকবিষয়ক বিশ্লেষক।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.