খালেদা জিয়ার প্রস্তাব কি মাঠে মারা গেল?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বেশ জমজমাট নাটক চলছে। নাটকের সূত্রপাত কে করেছেন, তা নিয়েও নানা রকমের বিতর্ক আছে। নাটকের মূল বিষয়, কার অধীনে হবে আগামী সংসদ নির্বাচন? এটি নাটকের বিষয় হতে পারে না। কারণ, নির্বাচন কীভাবে হবে, তা সংবিধানে বর্ণিত থাকে। বাংলাদেশেও তা-ই আছে এবং সব সময় ছিল। মাঝখানে ছেদ পড়েছিল ১৯৯১ আর ১৯৯৬ সালে। ১৯৯১ সালে ছেদ পড়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ, তখন বাংলাদেশের রাজনীতির সামরিকতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটছিল। উত্তরণের সময় অনেক কিছুই ঘটে, যা অন্য সময় সাধারণত ঘটে না। এই উত্তরণ যাদের ফসল, তারা সবাই বসে ঠিক করল—নির্বাচন হতে হবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কোথায় পাওয়া যাবে এমন সরকার? বাঙালির একটি ঈর্ষা করার মতো উদ্ভাবনী শক্তি আছে। সবাই মিলে ঠিক করা হলো, দেশের কর্মরত প্রধান বিচারপতি হবেন এই সরকারের প্রধান এবং সবাই মিলে ১০ জন নিষ্পাপ সাদা মনের মানুষ আবিষ্কার করবেন, যাঁরা ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যে যাঁর ঘরে ফিরে যাবেন। যেই কথা সেই কাজ।
প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১০ জন নিষ্পাপ সঙ্গী-সাথিকে নিয়ে বসলেন সরকারের শীর্ষ পদে এবং সময়মতো একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে বাহবা কুড়িয়ে যে যাঁর ঘরে ফিরে গেলেন। যথারীতি চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। দেশের মানুষকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব পেলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি ছিল, দেশ আবার সাংবিধানিক শাসনে ফিরে যাওয়া, যদিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জোর করে ক্ষমতা দখল করে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকেরা মূল সংবিধানটির সুবিধামতো ব্যবচ্ছেদ করে ফেলেছেন। তার পরও দীর্ঘ বিরতির পর দেশে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলো,  তা-ও বা কম কী। কিন্তু সবকিছু আবার বেহুদা তালগোল পাকিয়ে ফেলল মাগুরা আর ঢাকা-১০-এর উপনির্বাচন। মাগুরার নির্বাচনটি এতই তামাশাপূর্ণ ছিল যে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফকে রাতের অন্ধকারে মাগুরা সার্কিট হাউস ত্যাগ করতে হয়েছিল। এই দুটি নির্বাচনী তামাশা দেখে সব বিরোধী দল একযোগে দাবি তুলল, এর পরের নির্বাচনগুলো অবশ্যই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। অবশ্য এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় দাবি ছিল, পর পর তিনটি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে।
কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরই সবাই সে বিষয়টি ভুলে যায়। হয়তো সবাই মনে করে নিয়েছিল, এরপর দেশ সাংবিধানিকভাবেই চলবে। ১৯৯৬ সালে দাবিটি পুনর্বার উঠলে খালেদা জিয়া জানান, তিনি তা কিছুতেই মানবেন না। বললেন, শিশু আর পাগল ছাড়া দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই। তাঁর ওই বক্তব্য তখন সঠিক না হলেও, ২০১৩ সালে তা এক শ ভাগ সঠিক। সব দলের বর্জনের মধ্যেও খালেদা জিয়া সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথা বলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা একটি নির্বাচন করলেন এবং সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদকেও পবিত্র জাতীয় সংসদে সাংসদ হিসেবে প্রবেশের সুযোগ দিলেন। বাইরে তখন দেশ কাঁপানো গণবিক্ষোভ এই একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে। এসবের কিছুই হতো না, যদি মাগুরা আর ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে বিএনপির প্রার্থীরা জিততে না চাইতেন এবং নির্বাচন কমিশন নপুংসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতো। নির্বাচন ঠিকই সংবিধান অনুযায়ী চলত। গণবিক্ষোভের মুখে একতরফাভাবে নির্বাচিত সেই সংসদ বাধ্য হলো তাড়াহুড়া করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে। সেই সংসদ ভেঙে দিয়ে তিন মাসের মাথায় দেশে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগ জাসদ ও জাতীয় পার্টির সমর্থনে সরকার গঠন করে এবং পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। এই কৃতিত্ব শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের প্রাপ্য।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিএনপি তাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে কিছুটা চালবাজির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর পরিকল্পনা করে। হয়তো সেই বিচারপতি একজন ভালো প্রধান উপদেষ্টা হতেন, কিন্তু যে পদ্ধতিতে তাঁকে সেই পদে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তা ছিল অত্যন্ত অস্বচ্ছ এবং সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য। তার ওপর তিনি আইনজীবী থাকাকালে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার সংঘাত, আবার রক্তক্ষয়, আবার অনিশ্চয়তা। এরপর দেশে এল জরুরি অবস্থা, ক্ষমতা গ্রহণ করলেন খালেদা জিয়ার একদা আস্থাভাজন ফখরুদ্দীন আহমদ আর তাঁর পেছনে আরেক আস্থাভাজন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। সংবিধান অনুযায়ী থাকার কথা তিন মাস আর জরুরি অবস্থার মেয়াদ সংবিধান অনুযায়ী শেষ করতে হবে ১২০ দিনের মধ্যে। ফখরুদ্দীন সরকার বলল, কোনো কিছুই এখন প্রাসঙ্গিক নয়। মইনুদ্দিন বললেন, গণতন্ত্রের ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। তাকে আগে লাইনে তুলতে হবে। আমাদের সুশীল সমাজের কেউ কেউ সুযোগ-সুবিধার জন্য একবার ফখরুদ্দীনের দরবারে ছোটেন, তো আরেকবার মইনুদ্দিনের।
আম পাবলিক বিভ্রান্ত। ক্ষমতার চাবি যে কার হাতে, তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু ২০০৭ সালে এক ছাত্র বিস্ফোরণে বোঝা গেল, বাংলাদেশের ক্ষমতার চাবি সব সময় জনগণের হাতে। ক্ষমতা দখলকারীরা বললেন, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, হলো সাধারণ নির্বাচন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার এত অপব্যবহার হয়েছিল যে তা দুঃশাসনের এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছিল এবং নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট আর জাতীয় পার্টি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। মহাজোট দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। রায়ে আদালত বলেছেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একমুহূর্তের জন্যও রাষ্ট্রের শাসন অনির্বাচিত কোনো ব্যক্তির হাতে যেতে দেওয়া যায় না। পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে সেখান থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দিতে হবে এবং শুধু জনগণের নির্বাচিত সাংসদদের দ্বারা গঠিত হতে পারে নতুবা তা হবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তই হোক,
তা সংসদের মাধ্যমেই নিতে হবে। ব্যবস্থাটি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা মানে আদি সংবিধানের অধীনে ফিরে যাওয়া। খালেদা জিয়া আর তাঁর মিত্ররা বললেন, এসব কোনোটিই মানি না। নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। তারপর বললেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। কেন নয়, তার ব্যাখ্যা নেই। বর্তমান সরকারের অধীনে প্রায় ৬০০ নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি অনেকগুলোতে অংশ নিয়েছে এবং জিতেছেও। তার পরও শেখ হাসিনার প্রতি খালেদা জিয়ার অনাস্থা বোধগম্য নয়। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে দেশে চরম অশান্তি। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী গত শুক্রবার দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে জানিয়ে দিলেন, তিনি সবাইকে নিয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চান এবং নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে একটি সর্বদলীয় সরকার, যেখানে বিরোধী দলের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা সব মহলে প্রশংসিত হলো। কিন্তু দুই দিন পর খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব তিনি মানেন না। বরং তিনি নতুন ফর্মুলা দিয়ে বললেন, এই সরকার হবে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে দুই দলের নির্বাচিত ১০ জন উপদেষ্টা এবং তাঁরা মিলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সুশীল ব্যক্তিকে প্রধান করবেন। প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলে খালেদা জিয়ার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কী হলো?
এঁদের তো দুটি দল বাছাই করবে। দেশে তো অন্য দলও আছে। তদুপরি সমস্যা দেখা দিয়েছে, ওই সময়ে যাঁরা সরকারের সদস্য ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে চারজন মৃত্যুবরণ করেছেন। পাঁচজন অসুস্থ। কয়েকজন ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আর বেলতলায় যাবেন না। কেউ কেউ দেশের বাইরে। বাকি থাকল আমাদের নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তদুপরি এমন একটি সরকার সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। খালেদা জিয়া বলেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রপতি, স্পিকার বা সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদদের মতো নির্বাচিত করে আনা যেতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এই নির্বাচনগুলোর পদ্ধতি সংবিধানে নির্ধারিত। বিশারদেরা বলছেন, সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কীভাবে হবে, তার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ২৫ অক্টোবর জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাহলে সমস্যার সমাধান কোথায়? ইতিমধ্যে দুই দলের সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে চিঠি চালাচালি ও ফোনালাপ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলবেন। এর চেয়ে ভালো উদ্যোগ কিছু হতে পারে না। বাজারে জোর গুজব, জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। নানামুখী গুজব আরও আছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান আমার অত্যন্ত প্রিয় কলাম লেখক। শেখ হাসিনা মুখ থেকে কথা বের করলেই তিনি দাঁড়ি-কমার ভুল ধরতে বেশ তৎপর থাকেন। অপেক্ষায় আছি, তিনি খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে কী বলেন, তা পড়তে। তবে সব কথার শেষ কথা, দেশের মানুষ হানাহানির বদলে শান্তিতে থাকতে চায়। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.