গদ্যকার্টুন- সেই সব দিন by আনিসুল হক

ছোটবেলায় মেজো ভাই বলতেন, ‘রোজার ঈদের একটা ভালো দিক হলো, দুই মাস পরেই কোরবানির ঈদ। কিন্তু কোরবানির ঈদ চলে গেলে আবার ১০ মাস অপেক্ষা।’ ছোটবেলায় ঈদের রাতটায় খুব মন খারাপ হতো।
ইশ্, ঈদের দিনটা চলে যাচ্ছে। আর ঈদের আগের রাতটা? উফ্, দম বন্ধ করা এক খুশির কল্লোল সমস্তটা অস্তিত্বজুড়ে। রাত পোহালেই ঈদ। কী করি, কী করি। উত্তেজনায় তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতাম। ঘুম ভাঙলেই যে ঈদের দিন।

আমাদের একটা সেমাই বানানোর মেশিন ছিল। দুই ঈদের আগেই আমরা লেগে পড়তাম হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে সেমাই বানাতে। সেই সেমাই আবার পাটি বিছিয়ে শুকাতে দেওয়া হতো। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ত পাখি তাড়ানোর কাজটার। আমি ছাদের ওপরে একপাশে ছায়ায় বসে আছি। হাতে একটা পাটখড়ি। একা একা সেমাই পাহারা দিচ্ছি। তখন একটা কাগজের চোঙাকে মাইক বানিয়ে নিই। একটা কঞ্চির ডগায় সেই মাইক স্থাপন করি। লম্বা তার টেনে এনে একটা দেশলাইয়ের বাক্সে লাগাই। এটা হলো আমার মাইক্রোফোন। একটা ছোট্ট টুলের ওপর বসে শুরু করি বাংলাদেশ বেতারের ঈদের কার্যক্রম। বাসা থেকে যত কবিতার বই আছে, সব নিয়ে এসেছি। বিশেষ রকম প্রিয়: কাজী নজরুল ইসলাম। একের পর এক কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে। শুনছে দুটো শালিক, তিনটা চড়ুই, একটা দাঁড়কাক। সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ছিল ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দম’। এটা আবৃত্তি করে স্কুলে অনেকবার পুরস্কারও পেয়েছি।
এ কি বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ!
বে-দরদ দিল কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর-শোক।
জান্-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ,
কব্জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ, খাক চুমে নীলা তাজ...

এই যে নজরুল ইসলাম দুটো শব্দের বা তিনটা শব্দের মিল দিয়েছেন, সেটা আমাকে মুগ্ধ করত—ভর-ভর চোখ, আর জ্বর-জ্বর শোক।
আমাদের এক পড়শিনী আম্মাকে বলেছিলেন, আপনার এই ছেলেটা কি পাগল, একা একা কথা বলে। বিড় বিড় করে। আম্মা খুব রেগে গিয়েছিলেন। এখন মনে হয়, খুব বেশি মিথ্যা বলেননি পড়শিনী।
ঈদে নতুন কাপড়চোপড় পাওয়ার কোনো রেওয়াজ আমাদের ছিল না। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ছিল সব ভাইয়েরই। ঈদের আগে সেসব বের করে ধুয়ে ইস্তিরি করা হতো। ইস্তিরিও নিজেই করতাম। ইস্তিরির ভেতরে এক খোল ছিল, তাতে কাঠের কয়লা ভরে ফুঁ দিতে হতো। আর ছিল কিস্তি টুপি। একসঙ্গে আব্বার পিছে পিছে আমরা সব ভাই চললাম ঈদের জামাতে। বাজার থেকে দুই টাকা দিয়ে আতর কিনে আনা হয়েছে। অনেক সময় পাঞ্জাবিতে সেই আতরের লাল দাগ লেগে থাকত। একবার কোহিনুর বের করল চন্দন আতর। দাম হয়তো পাঁচ টাকা। সেটা কিনে আনা হলো বিশেষভাবে। আমাদের মর্যাদার চন্দনগন্ধ ভুরভুর করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঈদুল ফিতরে আরেকটা বিলাসিতা ছিল, ঈদসংখ্যা কেনা। বিচিত্রাই ছিল এক নম্বর, রোববার কিংবা সন্ধানীও কেনা হতো কখনো কখনো। হুমায়ূন আহমেদ আর সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন আমাদের সবচেয়ে পছন্দের লেখক। রশীদ করিমও কম যান না। আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দীনের গল্পে একটু বড়দের ব্যাপারস্যাপার থাকত, হয়তো আলাউদ্দিন আল আজাদেরটাতেও।
আমরা ছোটবেলায় কোরবানি দিতাম ভাগে। সাধারণত গরুর তিনটা ভাগ নেওয়া হতো। তবে কোরবানির গরু কিনতে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের উৎসাহ ছিল ব্যাপক। দূর দূর হাটে যেতেন বড় ভাইয়েরা। নিশবেতগঞ্জের হাট তেমনই একটা। লালবাগের হাটে গেলে আমাকেও সঙ্গে নেওয়া হতো। কোরবানির পর আমার কাজ ছিল গরুর একটা পা ধরে থাকা। কেউ হয়তো চামড়া ছিলছেন, কেউ হয়তো মাংস কাটছেন, কেউ বড় দা দিয়ে হাড় কাটছেন, আমি চিরটাকাল কায়িক শ্রমবিমুখ মানুষ, আমার জন্য কাজ বরাদ্দ ছিল গরুর একটা পা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর ভুঁড়িটা যখন কাটা হচ্ছে, আমি তখন বলতাম, একটা পর্দা যেন আমাকে দেওয়া হয়। আমি কৌটার এক মুখে সেই পর্দাটা লাগিয়ে শুকাতে দিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় একটা ঢাক।
তখন তো ফ্রিজ ছিল না। মাংস জ্বাল দিয়ে সারা রাত ফ্যানের নিচে শুকানো হচ্ছে। সারা বাড়ি কেবল মাংসের গন্ধ।
তখনো টেলিভিশন আসেনি রংপুরে। রেডিওতে ঈদের নাটক হতো। আমজাদ হোসেনের জব্বর আলী নাটকটা রেডিওতে শুনে আমরা সবাই হেসেই গড়াগড়ি। কারণ, মেয়ে চেয়েছে ম্যাক্সি, বাবা শুনেছেন ট্যাক্সি...
সে ছিল নিষ্পাপতার কাল। তখন সবকিছু কত সুন্দর ছিল। ঈদে যে নতুন কাপড় পেতে হয়, ঈদে যে কদমবুসি করলে সেলামি পাওয়া যায়, আমরা জানতামই না। তবু কী সুন্দর একেকটা ঈদের দিন আসত। যে বাড়িতেই যাই, সে বাড়িতেই খাওয়া। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন মুক্তা নামের আমার এক সহপাঠী ছিল, ওদের বাড়িতে আতাগাছ ছিল, আমি প্রায়ই গিয়ে পাকা আতা নিয়ে আসতাম। ঈদের দিনে ওদের বাড়ি গেছি, পায়েস খেতে দিয়েছিল, এত সুস্বাদু পায়েস, উফ্, ভদ্রতা করে অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, এখনো আফসোস করি, কেন পুরোটা খাইনি...
আমার আরেকজন খুব ভালো বন্ধু ছিল স্বপন। ওর বাড়িতে যেতাম পুজোর নাড়ু খেতে। ওদের বাসায় গেলে ডিমপোচও খেতে দিত। আমাদের বাসায়ও গরু ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, বাসায় কেউ বেড়াতে এলে ডিমপোচ আর এক গেলাস দুধ খেতে দেওয়া হতো। আমাদের এক শিক্ষক আমাদের বাসার নাম দিয়েছিলেন পুষ্টিবাড়ি। ঈদে স্বপন আসত আমাদের বাসায়, গরুর মাংস তখন সরিয়ে রাখা হতো। পূজা হতো পাড়ার রাস্তার ধারেই, ওটার পাশ দিয়েই চলাচল করতে হতো, বড় আম্মা হয়তো আমাকে দুধভাত খেতে দিয়েছেন, কাঁসার বাটিতে দুধ, গুড় মেখে লাল করেছি, কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছি, বড় আম্মা জিজ্ঞেস করতেন, এবার প্রতিমা কেমন হয়েছে রে?
ঈদের দিন সন্ধ্যার পরে দুই পায়ে ব্যথা করত। এত হেঁটেছি। তখন শুয়ে শুয়ে সেই আফসোস, ঈদুল ফিতরের পরে সান্ত্বনা আছে, ঈদুল আজহা আসবে, ঈদুল আজহার পরে আর সান্ত্বনা নেই। রাত বাড়ছে, আর মনে হচ্ছে, ইশ্, ঈদের দিনগুলো শেষ হয়ে গেল! কবে আবার ঈদ আসবে। সেই ১০ মাস পরে! প্রতি মাসে একবার করে ঈদ আসে না কেন?
বোন বলতেন, পাগল, প্রতি মাসে একবার করে ঈদ এলে ঈদের আনন্দই আর থাকবে না। বছরে দুবার করে আসে বলেই এত মজা! ছেলেবেলায় মন সেই যুক্তি মানতে চাইত না।
বাংলাদেশের ঈদের একটা অপূর্ব দিক আছে। বেশির ভাগ মানুষই তাঁদের আদিবাড়িতে ফিরে যান। বাবার কাছে, মায়ের কাছে, পিতৃপুরুষের কবরের কাছে। ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে কত দিন পরে দেখা হয়। কত কষ্ট করে তাঁরা যান। ট্রেনের ছাদে, বাসের ছাদে, লঞ্চের ছাদে। রাস্তায় যানজট, ছয় ঘণ্টার পথ যেতে লাগে ২২ ঘণ্টা। তবু প্রতিবছর তাঁরা যাবেনই।
ঈদ আমাদের মিলিত করে। ঈদ আমাদের উৎসের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ঈদ সমষ্টির জীবনকে আন্দোলিত করে, বর্ণিল করে, রঙিন করে! ঈদ আমাদের উজ্জীবিত করে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। এবং বিলম্বিত শারদীয় শুভেচ্ছা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.