ক্ষতির মুখে শিশু- রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিশুদের ক্ষতি by মুসলিমা জাহান

উম্মে ফাহমিদা ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। আগামী ৫ নভেম্বর তার জেএসসি পরীক্ষা শুরু।
এখন সে পড়াগুলো শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে এবং সমস্যাগুলো খাতায় টুকে রাখছে গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে সমাধান করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু টানা হরতালের কারণে তার গৃহশিক্ষক আসছেন না। ফলে সমস্যাগুলোরও সমাধান করতে পারছে না ফাহমিদা।

রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ও হরতালের কারণে ফাহমিদার মতো অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। হরতাল-অবরোধ-বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালীন নিরাপত্তার অভাবে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। আবার বিভিন্ন কর্মসূচিতে রাজধানীজুড়ে শুরু হয় অসহনীয় যানজট। তখন ছোট ছোট শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়। এতে স্কুলে যেতে দেরি হওয়ার পাশাপাশি অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এ রকমই একজন শিক্ষার্থী নাফিস আলম। ধানমন্ডিতে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। নাফিসের মা শাহানা আলম বলেন, আমার বাসা শনির আখরা। এমনিতেই স্কুলে পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লাগে, আর মিছিল-মিটিং হলে তো কথাই নেই। তখন বাচ্চা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পরের দিন স্কুলে আসতে চায় না।
এ ছাড়া হরতালের দিন বিদ্যালয় খোলা থাকলেও কোনো ক্লাস হয় না। এ জন্য অনেক সময় না পড়িয়ে বা তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস শেষ করিয়ে দেয় বলে অভিযোগ অনেক শিক্ষার্থীর। বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের বাধ্য হয়েই এমনটা করতে হচ্ছে। ক্লাস না হলে আমরা ছেলেমেয়েদের কীভাবে পড়াব বা তাদের সিলেবাস শেষ করব। তিনি আরও বলেন, এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় বিরাট ক্ষতি হলো।
অনম আহমেদ রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী এবং বরাবর ভালো ফলাফল করে আসছে। সমস্যা হয়, যদি পরীক্ষার সময় হরতাল থাকে। হরতালের কারণে স্থগিত হওয়া পরীক্ষাটি আবার নতুন রুটিন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অনম তখন পড়ার টেবিলে বসবে না কিছুতেই, বলবে পড়া তো হয়ে গেছে। মা জোর করলে বলে, এক পরীক্ষার জন্য আমি দুইবার পড়তে পারব না। ফলাফল স্বরূপ, শুধু ওই পরীক্ষাটিতেই খারাপ করে অনম। অনমের মা লুবনা আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, সরকার এবং বিরোধী দলের বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়ার সময় বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারটি খেয়াল রাখা উচিত। বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি গেজেটেড ছুটি ৭৫ দিন। এর বাইরে হরতাল, অবরোধ, নির্বাচন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনেক সময় ক্লাসে পাঠদান বন্ধ থাকে। শেরেবাংলা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, আসলে পরিস্থিতি এমন, ছেলেমেয়েরা ক্লাসের বৈতরণি ঠিকই পার হচ্ছে, কিন্তু পড়াশোনায় অনেক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না। পিছিয়ে পড়ছে তারা।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে দেখা গেছে, গত ১৬ জুলাই গাজীপুরে হরতাল চলাকালীন সহিংসতার মধ্যে বাসের নিচে চাপা পড়ে নাদিয়া সুলতানা নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এ সময় তার বয়স হয়েছিল নয় বছর। অপর এক ঘটনায়, গত ২৪ জুলাই হরতালের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতা বিশেষ করে হরতালে শিশুরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো শিশু গুলিতে মারা যাচ্ছে, কোনো শিশু ককটেল বিস্ফোরণে আহত হচ্ছে। সর্বোপরি, শিশুরা আতঙ্কিত হচ্ছে এবং অভিভাবকেরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ছাড়া শিশুদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের বিষয়টি থাকছেই। শিশুদের বিশেষ করে ভাসমান শিশুদের সামান্য টাকা বা খাবার দিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। জাতীয় শিশু নীতি অনুযায়ী রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় ককটেল বিস্ফোরণ, পিকেটিং বা মিছিলে শিশুদের ব্যবহার করতে দেখা যায়।

শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, রাষ্ট শিশুর সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দেশের আইন অনুসরণ করবে। কিন্তু আসলে যা হচ্ছে তা হলো, বাবা-মা শিশুকে বিদ্যালয়ে বা কাজে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। তাঁরা সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকছেন, কখন কী হয়। নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া তমালের স্কুল ধানমন্ডির কাকলি উচ্চবিদ্যালয়। আর ওর বাসা মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের কাছে। ওর বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে বাসায় না ফিরলে সবাই ওর খোঁজে লেগে যায়। ওর মায়ের কথা, দেশের যা অবস্থা, কখন কী হয়। একইভাবে আতঙ্কিত কড়াইল বস্তির রহিমা খাতুন। তাঁর ছেলে হিউম্যান হলারে সাহায্যকারীর কাজ করে। ওর আয়েই তাঁদের সংসার চলে। স্বামী আগে হিউম্যান হলার চালাতেন। গত জুন মানে দুর্ঘটনায় তিনি পঙ্গু হয়ে যান। হরতালে অন্য যানবাহন না চললেও হিউম্যান হলার চলে। কিন্তু হরতালের সময় পিকেটাররা ককটেল মারে। কিছুদিন আগেই মিরপুরের রাস্তায় ককটেলের আঘাতে তাদের প্রতিবেশী গুরুতরভাবে জখম হয়েছেন। এরপর থেকেই চিন্তা বেড়ে গেছে রহিমা খাতুনের। এ ছাড়া হরতালের সময় দোকান-মার্কেট বন্ধ থাকে। কাজে যেতে না পারায় শিশুদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক শিশুকে কাজ করতে হয়, অল্প বয়সেই ধরতে হয় সংসারের হাল। কিন্তু হরতালে কাজে যেতে না পারায় অনেক সময় তিন বেলা খাবার জোটে না তাদের। রায়েরবাজারের আসলাম একটি বুটিক হাউসে কাজ করে। কিন্তু হরতালের দিন দোকান বন্ধ থাকায় ওই দিন তার মালিক বেতন দেয় না। এ জন্য হরতালের দিন বিকেলে ধানমন্ডি লেকে ভিক্ষা করে আসলাম। আসলাম বলে, ‘হরতাল না থাকলে কোনো দিনই ভিক্ষা করতাম না। মাইনষের সামনে হাত পাততে শরম লাগে।’

No comments

Powered by Blogger.