গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ

মনোনয়ন-বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করা হলো। নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান বিরোধী দলের নীরব সম্মতির মধ্য দিয়ে নেতাদের দলবদল ও কালোটাকা দিয়ে ব্যবসায়ীদের সংসদে অনুপ্রবেশের সুযোগ-সংবলিত আইন পাস হলো। বিগত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারবিমুখ রাজনীতিকদের অনীহা সত্ত্বেও অন্তত তিন বছর দলের সদস্য না থাকলেও সংসদ সদস্য হওয়ার বিধান করা হয়েছিল। আমরা এটি সমর্থন করেছিলাম। কারণ, রাজনীতিতে কালোটাকার মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছিল। বড় দুই দলেই মনোনয়ন-বাণিজ্য ক্রমাগতভাবে সীমা অতিক্রম করছিল। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চাও যথেষ্ট নাজুক। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী শুধু টাকার জোরে দলীয় টিকিট বাগিয়ে ফেলছিলেন। গত নির্বাচনে প্রধান দুই দল খুব কম ক্ষেত্রেই গোপন ব্যালটে ভোটাভুটির মাধ্যমে মনোনয়ন দিয়েছে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দলীয় হাইকমান্ডের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিরা কিছুটা হলেও সংসদীয় আসনে বিনিয়োগ করতে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু গতকাল সংসদ তার অবসান ঘটাল। অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে গণতন্ত্রসম্মত উপায়ে প্রার্থী বাছাই। ব্যক্তি নয়, মার্কানির্ভর ভোটব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্র বিকাশের পথে বিরাট অন্তরায়। এই সংশোধনী তাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি একটি ছুরিকাঘাত। পরিতাপের বিষয়, বিগত নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় উদ্যোগে এই বিধান পাস হলেও এবার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন রহস্যজনকভাবে নীরব। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ক্ষীণ কণ্ঠে যুক্তি দিয়েছেন, জনপ্রতিনিধিরা চেয়েছেন বলেই সংসদীয় কমিটি এ সংশোধন এনেছে। সাবেক সিইসি যথার্থই প্রশ্ন তোলেন, গত নির্বাচনকালে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই এই বিধান করা হয়। অথচ এখন বলা হচ্ছে, এটা সংবিধানের পরিপন্থী। সে ক্ষেত্রে একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই সংশোধনীকে গণ্য করা যেতে পারে।
কারণ, প্রতিপক্ষকে বাদ দিয়ে একটি নির্বাচন করতে হলে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় বা মদদে দল ভাঙাগড়া এবং প্রার্থী বদলের হিড়িক পড়লেও যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তা এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে। এই সংশোধনীতে প্রতিটি দলের অপেক্ষাকৃত সৎ ও ত্যাগী নেতা, যাঁরা টাকার জোরে নয়, সংগঠনের জন্য কাজ করে সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটাও লক্ষণীয়, সংশোধিত আইনে জামানতের টাকা, নির্বাচনী ব্যয় ও অনুদানের টাকার অঙ্ক বাড়ানো হলেও কী উপায়ে নির্বাচনী খরচের ওপর ইসি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তার বিধান নেই। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের দণ্ড পেলে সাংসদ হতে পারবেন না। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও সম্প্রতি বলেছেন, দণ্ড পেলেই হলো, আপিল করলেও দণ্ডিত ব্যক্তি প্রার্থী হতে পারবেন না। অথচ গতকাল কেবল দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য করে আরপিও সংশোধন করা হয়েছে। এতে আইনের চোখে সমতার নীতির ব্যত্যয় ঘটল।

No comments

Powered by Blogger.