তিনি তো একচুল নড়লেন, উনি কী করলেন? by বদিউর রহমান

রাজনীতিতে শেষ কথা নেই বলে যে শেষ কথা আমরা হরহামেশা শুনে আসছি, তার বাস্তবায়নও তো আমরা হরহামেশাই দেখছি। খুনি ডাকাতকে আমরা আউলিয়া হতে যেমন দেখি, পাণ্ডা-গুণ্ডা-সন্ত্রাসী-বদমাশকে রাজনীতিক বনে যেতে যেমন দেখি, ঠিক তেমনিই নুরানি চেহারার ভালো মানুষ মনে করা মানুষগুলোকেও আবার চোর-হার্মাদ-লুটেরা হয়ে যেতে দেখি। তেমনি আবার আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে পরে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিতেও দেখি। অন্য দেশে এটা কত বেশি হয় তা না বলেও নিজ দেশে কী হচ্ছে, তা ভাবলেই যেন যথেষ্ট। তারপরও রাজনীতিই আমাদের শেষ ভরসা। দু’দিনের যোগী ভাতকে অন্ন বলার মতো তিন মাইস্যা বা সুযোগ বুঝে দু’বছইর‌্যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবশ্যই কোনো সমাধান নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যারা উপদেষ্টা হন, তাদের রুচি-অভিরুচি নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। হতে পারে তাদের কেউ কেউ হয়তো সমাজে তুলনামূলকভাবে ভালো, হয়তোবা নিরপেক্ষও; কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা যে কাজটি করে দিয়ে যান তা হল অপরাজনীতি আর অপকর্মকে জায়েজ করে দেয়া মাত্র। যে রাজনৈতিক দল বা জোট তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসে, সে দল বা জোট তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনে জিতে আসার লাইসেন্স পেয়ে যায়। স্থূল বা সূক্ষ্ম কারচুপির স্থূল বা সূক্ষ্ম অভিযোগ তাদের ওই লাইসেন্সকে খর্ব করতে পারে না, পাঁচ বছরের জন্য তারা শাহেনশাহ। এ পাঁচ বছর ওই সরকার যত নষ্টামিই করুক না কেন তা যেন বৈধ, তারা যে নিরপেক্ষ নির্বাচনে ম্যান্ডেট পেয়েছেন!
কী দরকার এ কথিত অরাজনৈতিক ব্যক্তিগুলোর ওইসব রাজনৈতিক জোট বা দলকে কার্যত নিরপেক্ষ নির্বাচনে একটা বৈধতার সিল মেরে দেয়ার? আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগেও চাইনি, এখনও চাই না। ইনশাআল্লাহ পাগল বা শিশু না হওয়া পর্যন্ত চাইবও না। ফখরুদ্দিন-মির্জা আজিজরা কারা, এরা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন? আকবর আলি-সুলতানা কামালরাই বা কারা যে তারা রাজনীতির পাঁচ বছইর‌্যা মেয়াদের সরকার নির্ধারণের রেফারিগিরি করবেন? তারা ভালো মানুষ হলে ভালো থাকুন, পাঁচ বছরের জন্য অপকর্মের/ভালোকর্মের লাইসেন্স দিতে রেফারিগিরিতে আসবেন কেন? যারা রাজনীতি করেন, যারা রাজনীতিকে বাজনীতিতেও পরিণত করেন, যারা সরকারে এসে দেশের মঙ্গল করার সঙ্গে সঙ্গে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে দেশের অমঙ্গলও করেন, তাদের নির্বাচনের রেফারিগিরি তারাই করুন। অতএব রাজনৈতিক পিঠা ভাগের জন্য অরাজনৈতিক বানর কোনোভাবেই প্রত্যাশিত হতে পারে না, কাম্য হতে পারে না।
রাজনীতিতে শেষ কথা নেই বলেই তিনি একচুলও নড়বেন না বলেও একচুল অবশ্যই নড়েছেন। এটা তার হার ভাবা বোকামি। আমি মনে করি, এটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বড় কৌশল। কেউ হয়তো বলতে পারেন, এই-ই যদি করবি বাপু, তবে কেন ‘খেল’ দেখালি? আমি বলব এ ‘খেল’টাই হচ্ছে রাজনীতি, এ ‘খেল’টাই হচ্ছে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আগেই যদি এ শেষ কথাটা (আপাতত) বলে ফেলি, তাহলে ওনাকে মেয়াদের শেষের ক’টা বছর ব্যস্ত রাখতাম কী দিয়ে? আগেই যদি সরকারের মেয়াদ শেষের পর কীভাবে কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে ঘোষণা করে দেই, তাহলে কি উনি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির অনেক সময় পেয়ে যেতেন না? তাকে তো ব্যস্ত রাখতেই হবে। তাই যদি তিনি না চাইতেন, তাহলে কি সরকারের মেয়াদ শেষের এত আগে তড়িঘড়ি করে আদালতের রায়ের অজুহাতে ইউ-টার্ন নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করে ফেলতেন? গ্রামের এক ভাসুরের ছোট ভাইয়ের বউকে বড় পছন্দ, বারবার কেবল বউয়ের দিকে তাকান। ভাসুর তো শ্বশুরতুল্য, মান্যবর, মাননীয়, সময়-সুযোগে মহামান্যও বটে, তারপর আবার রক্ষণশীল গ্রাম্য পরিবার বলে কথা। অতএব ছোট ভাইয়ের বউ অনেক বড় করে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে চলেন ভাসুরের সামনে। কিন্তু শাড়ির প্রস্থ তো সীমিত, ফলে বউয়ের পিঠ হয়ে পড়ে উদাম। ভাসুর ছোটমুখ ছেড়ে এবার উদাম বড় পিঠই দেখেন আর বলেন, এই-ই ভালো, তাই বড় ঘোমটা দিয়ে ছোট মুখ-চোখ-নাক ঢেকে চল, পর্দাও হোক, আর আমি তোর উদাম করা বড় পিঠটাই নির্বিঘ্নে দেখে যাই। তিনি পঞ্চদশ সংশোধনী করে ওনাকে কি সে অবস্থায় ফেলে দিয়ে ‘ভাসুর’ হলেন নাকি? তারপরও তিনি একচুল নড়লেন, পিঠ যা দেখার তাতো দেখেই নিলেন। তার এ একচুল নড়াতে অর্থাৎ সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবে তিনি হারেননি, তিনি জিতেছেন। ওনার সাঙ্গপাঙ্গরা হয়তো ঢোল বাজাচ্ছেন যে তিনি আমাদের ভয়ে এটা করেছেন, এক ধাপ এগিয়েছেন, একবারে তত্ত্বাবধায়কে চলে এলে শরম লাগবে না তার, তা-ই একটু একটু করে এগুচ্ছেন। ওনার চেলা-চামুণ্ডারা অর্থাৎ প্রধান রাজনীতিক হয়েও ওনার আন্ডা-বাচ্চা ছেলেকে ‘বাপ’ মানার, পুজো করার ব্যক্তিগুলো হয়তো এমন ডুগডুগিও বাজিয়েছেন যে, ২৫ অক্টোবরে সমাবেশ থেকেই তো সরকারের ‘পতন’ হয়ে যাবে। ভাবটা যেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি মিছিলের কিছু লোকের ধাক্কায় রানা প্লাজা ধসে পড়ে যেতে বলতে পারেন, তাহলে ২৫ অক্টোবর ওনাদের সমাবেশের পর সরকার পড়ে যাবে বলতে অসুবিধে কোথায়? আর স্মর্তব্য যে, উনিও কিন্তু এক সময়ে ক্ষমতায় বসতে ছাগল-প্রকল্প নিয়েছিলেন। আমার এখনও ভাবতে অবাক লাগে, ওনাকে ওই ছাগল-প্রকল্প নিতে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছিলেন কোন ‘ছাগল’ বা ‘ছাগলরা’। আল্লাহ মাফ করুন, এবার যেন উনি সরকার ফেলে দেয়ার ছাগলামিতে না যান।
ভালো কথা, উনি হলেন আপসহীন নেত্রী, ওনার চেলা-চামুণ্ডাদের দেয়া তকমা হচ্ছে দেশনেত্রী। তিনি ’৯০-এর দশকের প্রথমদিকে এবং এরশাদের আমলে আপসহীন থেকে এ আপসহীন খেতাব কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করেছেন। অপরপক্ষে তিনি এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে জাতীয় বেঈমান হবেন বলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউ-টার্নে গিয়ে ’৮৬-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জানি না তিনি ’৮৬-তে শত্র“র শত্র“ মিত্র ভেবে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছিলেন কি-না, কিংবা আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব রক্ষায় তখন কৌশলী হয়েছিলেন কি-না। তবে জাতি তখন তাকে জাতীয় বেঈমানই ভেবেছিল। এরশাদ অবশ্যই তার প্রতিদান দিয়েছেন, ভাতিজার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েও ইউ-টার্নেই ‘মহাজটে’ শামিল হয়েছেন। আমি বলি, ‘বিশ্ববেহায়াই’ বলুন আর ‘স্বৈরাচারই’ বলুন, এরশাদই এ দেশে বাপের ব্যাটা এবং দেশের রাজনীতির অঙ্গনের একমাত্র ‘পুরুষ’। তারপর কি আর এ দেশে কোনো রাজনৈতিক পুরুষ আপনারা দেখেছেন? যতই তাল-বেতাল করুন না কেন, যতই মামলার জুজুতে তাকে ঘায়েল করুন না কেন, তারপরও গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের সময়েই হোক, আর এবারের গণভবনের নেমন্তন্নেই হোক, এরশাদ দেখা যায় এখনও বাপের ব্যাটা। কিন্তু উনি (দেশনেত্রী) আপসহীন থাকতে চাচ্ছেন কোন ভরসায়? সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় যেতে তার এত অনীহা কেন? এতে তার সমর্থন যে কমছে, তা উনি বুঝতে পারছেন না?
তার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আর ওনার পাল্টা প্রস্তাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আমরা যারা আমজনতার সঙ্গে মিশি, কথা বলি, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, তাদের কাছে তার আর ওনার প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাবের একটা তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ আছে। গোঁয়ার্তুমি করা আর দৃঢ় থাকা এক কথা নয়। এ বিবেচনায় তিনি গোঁয়ার্তুমি বর্জন করে একচুল নড়ে আপসের পথে এসেছেন, সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। আর উনি ওনার গোঁয়ার্তুমি ধরে রেখেছেন; ’৯৬ ও ২০০১-এর ২০ উপদেষ্টা থেকে ১০ জন নিয়ে আর সবার সম্মতিতে প্রধান উপদেষ্টা করে দেয়ার পাল্টা প্রস্তাবে নতুনত্ব নেই, ওনার গোঁ-ই ঠিক রাখলেন। জনগণ এখন ভাবছে, তিনি তো নরম হয়েছেন, উনি কেন হচ্ছেন না? তাহলে উনি কি সংঘাতই চান? হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠেছে, তিনি তার ভাষণে বেশকিছু অস্পষ্টতা রেখেছেন। রাখবেনই তো, তা না হলে ওনার সঙ্গে আলোচনা হবে কী নিয়ে, দরকষাকষি হবে কী নিয়ে? এটাই তো রাজনীতির বলুন আর বাজনীতিরই বলুন, খেলা। বড় মাছকে বড়শিতে আটকিয়ে কি একটানে তোলা যায়? তা করতে গেলে যে হয় সুতা ছিঁড়ে যাবে, নয়তো বড়শি ভেঙে যাবে যে! বড় মাছের মুখ না হয় কিছুটা ছিঁড়বে, কিন্তু মাছ তো বেঁচে যাবে। অতএব সুতা ছাড়তে হয়, সুযোগ বুঝে আবার একটু টানা, আবার ছাড়া- বড় মাছকে নিয়ে খেলার মজাটিই আলাদা। থাক না কয়েক ঘণ্টা, কয়েকদিন, মাছটাকে রাখতে হয় টানটান অবস্থায়, জলের ভেতর নিরাপদ আশ্রয়ে অন্য বড় গাছের গুঁড়িতেও যেন না লুকাতে পারে- তাও তো দেখতে হয়, নাকি? তিনি এখন রাজনৈতিক খেলা খেলছেন। সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেয়ায় তার জনসমর্থন বেড়েছে, মানুষ তাকে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ভাবছেন। ওনাকে পরে সুযোগমতো বড় বেকায়দায় ফেলার জন্যও এটা জনমত পক্ষে আনার একটা বড় রাজনৈতিক প্রাপ্তি। উনি এগিয়ে না এলে, পরে ‘ভিন্ন’ কিছু ঘটলে বা ঘটানো হলে তখন জনগণ বলবে, ওনার গোঁয়ার্তুমির জন্যই তো এটা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে আবার ওনার প্রস্তাবই যদি গ্রহণ করবেন, তাহলে তিনি এতদিন পঞ্চদশ সংশোধনীর পর খেলেছেন কি এমনি এমনি? উনি কি পাগল নাকি যে ভাববেন, তিনি নিজ হাতে বিষপান করবেন? ভিন্ন কিছু ঘটে গেলে লোকসান হবে ওনার, তার নয়। বরং তার লাভ হবে, তিনি আরও সময় পাবেন; আর ওনার ক্ষতি হবে, তিনি ৭ বছরের পর আরও ক্ষমতার বাইরেই থাকবেন। তার প্রস্তাবে এগিয়ে এসে নির্বাচনে গেলে ওনারই লাভ, পরে ক্ষমতায় এসে উনিই তার প্রস্তাবের পরবর্তী সুবিধাভোগী হবেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পোক্ত হলে, ওনার বরং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করেই পরবর্তী সুবিধাভোগী হওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করা বোকামি ভাবি আমি।
আগেও লিখেছি, ফয়সালা একটা হবেই, লক্ষণও ভালো, তারপরও তিনি-উনি যদি শেষতক বেঁকে বসেন, তাহলে আমার পূর্ব ফর্মুলায়ই আসুন, নির্বাচনকালীন সরকার দলীয় ও তত্ত্বাবধায়কের সমন্বয়েই হোক- তিনি পাঁচজন মন্ত্রী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, উনি পাঁচজন উপদেষ্টা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হবেন। নাজুক কিছু মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে, বাকিগুলো আপসে অথবা আপসে সম্ভব না হলে লটারির মাধ্যমে তিনি-উনির মধ্যে ভাগ হবে। সংবিধান সংশোধন করতে হলে ‘কী বিচিত্র’র এ দেশে নতুনত্ব আনুন।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.