ইস্পাহানীর নেতৃত্বেই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা লুট করে ব্র্যাক ব্যাংকের কোটি টাকা by ওয়েছ খছরু

সুনামগঞ্জ শহরের দুর্ধর্ষ অপরাধী ও ছাত্রলীগ ক্যাডার হাসানুজ্জামান ইস্পাহানীর নেতৃত্বে সিলেট শহরের একটি পেশাদার ছিনতাই চক্র লুটে নিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের কোটি টাকা।
বেশ কয়েক দফা মহড়া ও সিলেট থেকে বিশ্বনাথ পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিজস্ব সোর্স বসিয়ে ওই টাকা লুটে নেয় তারা। ঘটনার পরপর তাদের অনেকেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে অবিরাম চাপ সৃষ্টি করছেন পুলিশের ওপর। তবে, তদন্তে নেমে কারা টাকা নিয়েছে, কিভাবে নিয়েছে এসবের কাছাকাছি পৌঁছে যায় পুলিশ। তারা চোখ-কান বন্ধ করে রাতেই অভিযান চালিয়ে ঘটনার অন্যতম হোতা হাসানুজ্জামান ইস্পাহানীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে। ঘটনার চারদিন পর এব্যাপারে পুলিশ ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার পর বহুমুখী চাপের কারণে ক্লু উদঘাটনে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছে পুলিশ। পুলিশও ঘটনার শুরু থেকে বলছে, এ ঘটনার পেছনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। সিলেটের ব্র্যাক ব্যাংকের একাধিক ব্রাঞ্চের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, এমনিতে সিলেট মেট্রোপলিটন ও জেলা পুলিশ প্রশাসন লোকবল সঙ্কটের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। এ কারণে শুধু ব্র্যাক ব্যাংক নিয়ে সিলেট শহরের বেশির ভাগ সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা অনেকটা গোপনীয়ভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বহন করছেন। তেমনিভাবে রোববার ব্র্যাক ব্যাংকের বিশ্বনাথ ব্রাঞ্চের প্রায় এক কোটি টাকা নিয়ে বিশ্বনাথের পথে রওনা দিয়েছিলেন সহকারী ম্যানেজার গহর আলতাফ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলো ব্যাংকের প্রাইভেট কারের চালক সোহেল আহমদ ঝিনুক। ওই দিন গহর আলতাফ চৌধুরী সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ও দক্ষিণ সুরমা ব্রাঞ্চ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। আর বিকাল পৌনে ৩টার দিকে ওই টাকা নিয়ে তিনি সিলেটের বিশ্বনাথে যাচ্ছিলেন। ঘটনার পর পর ব্যাংক কর্মকর্তা গহর আলতাফ চৌধুরীই সাংবাদিক সহ পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, গাড়ির ভেতরে পেছনের সিটে একটি ব্যাগের ভেতর রাখা ছিল টাকা। গাড়িটি যখন অতিরবাড়ি এলাকায় পৌঁছে তখন তিনটি মোটরসাইকেলে মোট ৬ জন ছিনতাইকারী প্রথমে এসে তাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে একটি মোটরসাইকেলের চালকের সঙ্গে ব্যাংকের গাড়ির ড্রাইভারের বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ছিনতাইকারীরা কৌশলে গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়। এ সময় তারা গাড়িতে লাঠিসোটা নিয়ে আঘাতও করে। এ সময় ছিনতাইকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে রাখে। কেউ কেউ পকেট থেকে চাকু ও চাপাতি বের করে। এরপর তারা নির্জন এ স্থান থেকে টাকার ব্যাগ নিয়ে সিলেট শহরের দিকে চলে যায়। এদিকে, পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার পরপরই পুলিশ ছিনতাইকারীদের সন্ধান শুরু করে। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্ত সহ পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা মোবাইল ট্র্যাকিং সহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন তথ্যের অনুসন্ধান শুরু করেন। আর এই অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে প্রাথমিক ভাবে পাওয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রের প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জে চালানো হয় অভিযান। সোমবার ভোররাতে সিলেট ও সুনামগঞ্জের পুলিশ একযোগে শহরের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ছাত্রলীগ ক্যাডার হাসানুজ্জামান ইস্পাহানীকে গ্রেপ্তার করতে শহরের আরফিন নগরে যায়। এ সময় পুলিশ তার বাসা ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করতে চাইলে ইস্পাহানীর পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। এক পর্যায়ে ইস্পাহানী পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছুড়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ইস্পাহানীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল পর্যন্ত ওসমানী হাসপাতালে ইস্পাহানীকে পুলিশি প্রহরায় রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। তবে, ইস্পাহানীকে কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি তাকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। পুলিশ বলছে, তদন্তের স্বার্থে এখনই তাকে মুখোমুখি করা হবে না। তবে, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্ত গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ইস্পাহানী ঘটনার সঙ্গে যে জড়িত প্রাথমিক তদন্তে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইস্পাহানীর সঙ্গে সিলেট শহরের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর যোগাযোগ রয়েছে। তিনি জানান, ইস্পাহানী সুস্থ হলে তাকে রিমান্ডে নেয়া হবে। তবে, রঞ্জন সামন্ত দাবি করেন, কোটি টাকা ছিনতাই ঘটনার তদন্তে পুলিশ অনেক দূর এগিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ কারও তদবির না শুনেই ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এব্যাপারে মামলার বাদী ব্র্যাক ব্যাংক বিশ্বনাথ শাখার ম্যানেজার আলী আহসান সিদ্দিকী মীরান গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্তে অনেক দূর এগিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ইস্পাহানী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, পুলিশের তদন্তই প্রমাণ করে এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের কেউ জড়িত নয়। এরপরও যদি পুলিশের কাছে তথ্য থাকে তাহলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদন্ত কর্মকর্তাকে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে। ঘটনার পরপর ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা সাবেক স্কোয়াড্ডন লিডার সালেহ আহমদ খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের দল সিলেটে আসে। তারা এনিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরে গেছেন।
কে এই ইস্পাহানী: ইস্পাহানী সুনামগঞ্জ শহরবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। গ্রামীণ এই শহরের কুখ্যাত অপরাধী হিসেবে সে সবার কাছে পরিচিত। শুধু ইস্পাহানীই নয় আরফিন নগরে তার ভাইয়েরাও একই সঙ্গে মূর্তিমান আতঙ্ক। ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। বর্তমান সরকারের সময়ে বিগত সাড়ে ৪ বছরে সে একাধিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। আর সোমবার ভোররাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর স্বস্তি ফিরে পাওয়া সুনামগঞ্জ শহরের মানুষের মুখে মুখে রটছে ইস্পাহানীর নানা কীর্তি। তার পুরো নাম হাসানুজ্জামান ইস্পাহানী। কিশোর কাল থেকেই সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে কোন কালেও সে ছাত্রলীগের কোন কমিটিতে স্থান পায়নি। সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুটের আস্থাভাজন হিসেবে ইস্পাহানী যখন যা ইচ্ছা তখন তা করে বেড়িয়েছে শহরে। তার কারণেই এখন অনেকটা অশান্তির শহর সুনামগঞ্জ। পাড়ায় পাড়ায় ছিনতাই, জলমহাল দখল, জমি দখল, বাসস্ট্যান্ডে নিয়ন্ত্রণ- এমন কোন অপরাধ নেই সেখানে সে পা মাড়ায়নি। বর্তমানে ইস্পাহানী বঙ্গবন্ধু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জোটের সদর উপজেলার সভাপতি। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ইস্পাহানী সুনামগঞ্জ শহরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সব মিছিলে সামনের সারিতে থাকতো। সিনিয়র নেতার কারণেই সে দলের ভেতরেও বেশ দাপট খাটিয়েছে এই সময়ে। তবে, সোমবার ভোররাতে ইস্পাহানী গ্রেপ্তারের পরপরই বঙ্গবন্ধু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জোটের সদর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে এমন কথা জানিয়েছেন সংগঠনের জেলা সভাপতি একে রুমেল। সুনামগঞ্জ শহরে রয়েছে ইস্পাহানীর একটি নিজস্ব গ্রুপ। এই গ্রুপ ট্রাফিক পয়েন্ট, পুরাতন বাজার, নতুন বাজার সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আধিপত্য বজায় রেখে চলে। তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে স্থানীয় সন্ত্রাসী ফরহাদ, মুন্না ও বাবুল এটি নিয়ন্ত্রণ করে। এই অপরাধী গ্রুপে ৩০ থেকে ৪০ জন সদস্য। সব রকমের অপরাধের পর সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে তারা বেশ আদুরে পাত্র। সুনামগঞ্জ সদর থানা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, প্রায় দুই মাস আগে সুনামগঞ্জ বার্ড-এর এক মহিলা কর্মকর্তার টাকার ব্যাগ ছিনতাই করে ইস্পাহানী সহ তার সহযোগীরা। এ ঘটনার পরপরই পুলিশ ইস্পাহানী সহ তার ৬ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ইস্পাহানীকে হাজতে আটকে রাখতে পারেনি পুলিশ। সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ওই নেতার হুমকির মুখে ইস্পাহানীকে গোপনে ছেড়ে দেয়া হয়। ওই সময় ফরহাদ সহ বেশ কয়েকজনকে মামলায় আসামি করা হয়েছিল। সুনামগঞ্জ শহরে সব ছিনতাইয়ের মূল হোতা ইস্পাহানী ও তার সিন্ডিকেট। প্রতিদিন গড়ে তারা একটি করে ছিনতাই করে নগরীতে। ইস্পাহানীর একটি নারী সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের নারীরা শহরের পশ্চিমবাজার সহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকার ব্যবসায়ীদের কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। পরে ওই ব্যবসায়ীদের ফুঁসলিয়ে নিয়ে উলঙ্গ মহিলার সঙ্গে ছবি তোলা হয়। আর ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এভাবে গত ৬ মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইস্পাহানী ও তার চক্রের সদস্যরা। পশ্চিম বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, মান সম্মানের ভয়ে ইস্পাহানীকে টাকা দিয়ে ছবি আনা হয়েছে। এরপরও মাঝে মধ্যে এসে ইস্পাহানী টাকা দাবি করতো। ইস্পাহানী এখন বিবাহিত। তবে, তার বিয়েতেও হয়েছে নাটকীয়তা। শহরের কালীবাড়ি এলাকার মধ্যপ্রাচ্যের এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে ছিল তার গোপন সম্পর্ক। প্রায় এক মাস আগে ওই প্রবাসীর স্ত্রীকে সে অনেকটা জোর করেই নিয়ে এসে বিয়ে করে। এখন প্রবাসীর স্ত্রীই তার স্ত্রী। প্রবাসীর পরিবার একাধিক স্থানে অভিযোগ করেও সুবিচার পাননি। সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি এনামুল হক গতকাল স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, ইস্পাহানী তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, ইস্পাহানী এখন সুনামগঞ্জের ত্রাস। তার গডফাদারও রয়েছে। এ কারণে কেউই আইনের আশ্রয় নিলেও কাজ হয় না। তার সঙ্গে সিলেটের অপরাধীদের রয়েছে ভাল সম্পর্ক। বিভিন্ন সময় একত্রে জেল ও হাজতবাসকালেই তাদের সম্পর্ক হয় বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সুরমা থানা ওসি রঞ্জন সামন্ত। এ কারণে সুনামগঞ্জে জমি দখল, জলমহাল দখলে সিলেটের চিহ্নিত অপরাধীদের ব্যবহার করা হতো। এর আগে একাধিক বারও ইস্পাহানী সিলেটের অপরাধ কর্মের সরাসরি মিশনে অংশ নিয়েছে। নগরীর আম্বরখানা, সুবিদবাজার এলাকায় ছাত্রলীগ নামধারী ছিনতাইকারী চক্রকে নিয়ে সে সিলেটের কোটি টাকা লুটের অভিযানে অংশ নিয়েছে। এ বিষয়টি ইতিমধ্যে ব্যাংক ও পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তবে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, যদি আসামিদের চিহ্নিত করা হয় তাহলে লুট হওয়া টাকা উদ্ধারে অযথা বিলম্ব করা হচ্ছে কেন? ওসি রঞ্জন সামন্ত জানিয়েছেন, পুলিশ টাকা উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টায় রয়েছে। এদিকে, এ ঘটনার সঙ্গে ইতিমধ্যে সম্পৃক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি পুরো ছিনতাই চক্রকে রক্ষা করতে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

No comments

Powered by Blogger.