পোশাক শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসুন by ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে বিশেষ করে দুটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভীতিকর চক্রের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে- আগামী জাতীয় নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হলে তা সরকার, জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত হবে কি-না কিংবা আদৌ নির্বাচন হবে কি-না, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের অঘটন অবশ্যম্ভাবী, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক অবস্থাকে হুমকির দিকে নিয়ে যাবে। সব রাজনৈতিক দলের স্মরণ রাখা উচিত, প্রকৃতি অনির্দিষ্টকালের জন্য শূন্যস্থান খালি রাখে না। কখনও কখনও প্রকৃতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি বড় অশনি সংকেত দৃশ্যমান। দ্বিতীয় অন্য যে ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেটি হল, পোশাক শিল্পে কর্মরত নর-নারী, যারা একসময় অজপাড়াগাঁয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিল এবং তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরে এসে পোশাক শিল্পের বদৌলতে কর্মে যোগ দিয়ে স্বাধীনভাবে একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছিল, তাদের কর্ম হারানোর আশংকা। উল্লেখ্য, দেশের প্রায় ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের মধ্যে ৩০ লাখেরও বেশি গ্রাম থেকে আসা শিক্ষাহীন, অনভিজ্ঞ অবলা নারী। তাজরিন গার্মেন্ট ও সাভারের রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ শ্রমিকদের আবারও কর্মহীন হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী ওইসব দুর্ঘটনার উদ্ধার কাজ এবং বিকৃত লাশের ছবি সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় এবং পত্রিকায় প্রকাশ করা। বিশ্বের প্রধান প্রধান মিডিয়া যেমন- আল জাজিরা, বিবিসি, সিএনএনসহ সব মিডিয়া এ চিত্রগুলো সারাবিশ্বে সম্প্র্রচার করেছে। এসব বিকৃত লাশের ছবি দেখে উন্নত বিশ্বের খুচরা ক্রেতাদের মাঝে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ক্রয়ের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনীহা লক্ষণীয়। এছাড়াও একটি চক্র বিশ্বের জনগোষ্ঠীর কাছে এমন একটা বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, বাংলাদেশের পোশাকে গরিবের রক্তের দাগ আছে, যা বাংলাদেশের অনেক অর্জনকে বিলীন করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা অনেক বেশি মাত্রার মর্মান্তিক ছিল। মৃতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজারের বেশি। কিন্তু সেদেশের সরকার অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সব এলাকা সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও করে ওই এলাকায় টেলিভিশন, পত্রিকার সাংবাদিক বা জনগণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলে বিশ্বের কোথাও কেউ ওই দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ এবং কোনো বিকৃত লাশের ছবি দেখার সুযোগ পায়নি। বাংলাদেশ সরকারেরও জাতীয় স্বার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু দলীয় রাজনীতির কাছে রাষ্ট্রের এ বৃহত্তর স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বরং উল্টো প্রতিদিন একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সংবাদ কর্মী এমন সব মন্তব্য করেছেন, যা থেকে বোঝা গেছে বিষয়টি সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞান অনুপস্থিত। ২০০৫ সালে পবিত্র হজের সময় মক্কায় একটি ১২ তলা ভবন ধসে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু সে দেশের সরকার কোনো লাশের ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেনি। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে বিভেদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ খাতের শ্রমিকদের বেকার বা কর্মহীন হওয়া থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, তার একটি ন্যায়সঙ্গত ও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সবার কর্তব্য এবং এ নিয়ে সব ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য জরুরিভাবে বন্ধ হওয়া উচিত।
শ্রমিক অধিকার ও তাদের সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে এবং একই সঙ্গে কারখানার ভবন বিল্ডিং কোড অনুযায়ী মানসম্মত হতে হবে। অগ্নি দুর্ঘটনার আশংকা হ্রাস করার প্রয়াস নিতে হবে। এসব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা খুব বেশি দুরূহ কিছু নয়- প্রয়োজন শুধু স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা এবং যুগোপযোগী আইন করে দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়া এবং বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দেয়া। শ্রমিকদের নিরাপদ আবাসন, পরিবেশ, চিকিৎসা এবং তাদের সন্তানদের বিনা খরচে শিক্ষার সুযোগ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী রেশনিংয়ের আওতায় আনা জরুরি। সেই সঙ্গে শ্রমিকদেরও কর্মদক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
বর্তমান সংসদ পোশাক শিল্প শ্রমিক ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন করার উদ্দেশ্যে Apparel Workers Welfare Act-2013 আইন করেছে এবং Apparel Workers Welfare Scheme-2013 নামে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর মাধ্যমে ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন করে নিুোক্ত ব্যবস্থাদি নেয়া গেলে একদিকে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে তাদের জীবিকা নির্বাহ সহজতর হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শিল্পে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন করা হবে। ওই কারখানা সময় সময় তাদের অবস্থান বোর্ডকে পেশ করবে। বোর্ড আইনের ধারা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার রাখবে। হতে পারে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বা এর অধিক সদস্য নিয়ে একটি বোর্ড। বিজিএমইএ/বিকেএমইএ’র প্রতিনিধি প্রয়োজনীয় শ্রমিক প্রতিনিধি শ্রম মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন করে মোট দুজন (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), সুশীল সমাজের বিজ্ঞ তিনজন, বিশিষ্ট দুজন ইঞ্জিনিয়ার (একজন ইলেকট্রিক্যাল এবং অন্যজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার), শিপিং এজেন্ট, কনটেইনার অপারেটর, ফ্রেইড ফরোয়ার্ডার, জাহাজ মালিক, ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (মেম্বার পদের নিচে নয়) প্রতিনিধি নিয়ে উপরোক্ত বোর্ডটি গঠন করা যেতে পারে। ওই বোর্ডে সুশীল সমাজের সদস্য থেকে একজন চেয়ারম্যান, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে দুজন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাকি সদস্যরা বোর্ডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। উপরোক্ত বোর্ড একজন যোগ্য প্রধান কর্মকর্তা (সিইও) এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে, যারা দৈনন্দিন কাজের তদারকি করবেন। এ কাজগুলো করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে- যা নতুন আইনের ধারা অনুযায়ী শিল্পের ঋণপত্র থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যাংক কর্তন করে বোর্ডে জমা দেবে এবং এ শিল্পের মাধ্যমে যারা বেনিফিশিয়ারি, তাদের ওপর বোর্ড ন্যায্য হারে কর ধার্য করবে। যেমন- পোশাক শিল্পে আমদানি-রফতানির কারণে শিপিং এজেন্ট, বার্থ অপারেটর, ফ্রেইড ফরোয়ার্ডার, জাহাজ মালিক, ব্যাংক, বীমা ও বন্দর কর্তৃপক্ষ এ শিল্পের কারণে অধিক মাত্রায় ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করছে এবং সে কারণে তাদের ওপর বাধ্যতামূলক কর ধার্য করা যেতে পারে। এছাড়াও সরকার ঋণপত্রের FOB থেকে যে ০.৮০ শতাংশ source tax হিসেবে কর্তন করে- সেখান থেকে ০.৪০ শতাংশ শ্রমিক ওয়েলফেয়ারের জন্য বোর্ডে জমা দেবে। এছাড়া বিশ্বের অনেক দেশ এবং বড় বড় ক্রেতা আর্থিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসার সম্ভাবনাও আছে- যদি আমরা তাদের কাছে যথাযথ প্রস্তাবনা ও যুক্তি তুলে ধরতে পারি।
উপরোক্ত অর্থ আদায় করা হলে তাতে পোশাক শিল্পের প্রত্যেক শ্রমিকের আবাসন, হাসপাতাল, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং তাদের সন্তানদের জন্য স্কুল তৈরি করা অতি সহজে সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকরা বিনামূল্যে এ সুযোগ ভোগ করবে। সরকার বিভিন্ন এলাকায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরের কিছুটা বাইরে) খাসজমি বা ভূমি অধিগ্রহণ করে বিনামূল্যে জায়গার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, চট্টগ্রাম বন্দরের ডক শ্রমিকদের জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। পোশাক শিল্পের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং এ শিল্পে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে। এ কারণে প্রত্যেক পোশাক শ্রমিকের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যে কোনো কল্যাণমুখী সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। এ ব্যবস্থাগুলো নেয়া হলে শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহের খরচ বহুলাংশে কমে যাবে।
যুগোপযোগী পোশাক কারখানা নির্মাণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের প্রান্তে ‘অর্থনৈতিক জোন’ (কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়) করে বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিককে দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেয়ার ব্যবস্থা অতি দ্রুততার সঙ্গে করা দরকার। এ শিল্প নির্মাণে যৌক্তিক সুদে ব্যাংক কর্তৃক দীর্ঘমেয়াদি প্রজেক্ট ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা নিলে অতি দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বমানের কারখানা গড়ে উঠবে অথবা সেখানে বিল্ডিং তৈরি করে ভাড়া পদ্ধতিও গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমনটি ইপিজেডে করা হয়েছে। শহর অঞ্চল থেকে শিল্পগুলো বাইরে চলে গেলে একদিকে যানজট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে, অন্যদিকে শহরের পরিবেশ বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে। সমাজের সচেতন নাগরিক, বিজিএমইএ/ বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে উপরোক্ত সুপারিশের আলোকে বা আরও কোনো উন্নত পদক্ষেপ নিলে তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে।
পরিশেষে সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, পোশাক শিল্পে ধস নামলে শুধু এ শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিক ও কর্মচারী নয়, বরং ব্যাংক, বীমাসহ সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা সামাল দেয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না। গার্মেন্ট মালিকরা হয়তো অন্য কোনো ব্যবসা বা অন্য দেশে নতুন কিছু করার উদ্যোগ নিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ শিল্পের গরিব অসহায় শ্রমিকরা। এ পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক খাতকে রক্ষা এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যথাযথ সহযোগিতা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী : সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স ও বাংলাদেশ শিপিং এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন

No comments

Powered by Blogger.