নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- ‘সেরা’ বিশ্ববিদ্যালয়, ‘সেরা’ ব্যবস্থাপক! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বসেরা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে বছরের সেরা ব্যবস্থাপক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার বরাত দিয়ে চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত এই সংবাদটি পড়ে যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছি। আনন্দ এই কারণে যে এককালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এর যেকোনো কৃতিত্ব সাবেক ছাত্রকে আনন্দের অংশীদার করে। বিস্ময়ের কারণ অনেক। পাহাড়-অরণ্যঘেরা এই অসাধারণ প্রকৃতিশোভিত ক্যাম্পাসটি নানা কারণে খবরের শিরোনাম হয়েছে, যার অধিকাংশই নেতিবাচক। রাতারাতি কী এমন অর্জন তাকে ‘সেরা’ অভিধার উপযুক্ত করে তুলল, কিংবা এর উপাচার্যই বা কী এমন যোগ্যতাবলে ‘সেরা’ ব্যবস্থাপক মনোনীত হলেন—এসব প্রশ্ন মনে আসেই। আর এসব প্রশ্ন থেকেই বিস্ময়ের জন্ম।
দেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে স্বীকৃতি পেলেই একটা গদগদ ভাব জন্ম নেয় আমাদের মনে। সুতরাং ইউরোপিয়ান বিজনেস অ্যাসেম্বলির (ইউবিএ), অক্সফোর্ড সামিট অব লিডারস শিরোনামের আয়োজনটি সমীহ জাগিয়েছিল মনে। এ ব্যাপারে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বর্তমান প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। বললেন, ‘প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহমদের পিএইচডি ডিগ্রি লাভের খবরটা পাঠ করেছিলাম পত্রপত্রিকায়। একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই ডিগ্রি পান তিনি। “অক্সফোর্ড” নামটি যুক্ত থাকায় কৌতূহলবশত অনলাইনে গিয়ে দেখতে পেলাম, এই প্রতিষ্ঠানটি আগে ছিল একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। ১৯৯৫ সালে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ‘অধ্যাপক’ পদের শিক্ষক ছিলেন মাত্র একজন। বাকিরা সহকারী অধ্যাপক বা প্রভাষক। আসল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপকের সংখ্যা অন্তত পাঁচ শ।’
যা হোক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর উপাচার্যকে ‘সেরা’ হিসেবে স্বীকৃতিদাতা যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি তাদের আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে ‘অক্সফোর্ড’ শব্দটি জুড়ে দেওয়ায় বোঝা গেল অক্সফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, কেমব্রিজ নামগুলো ব্যবহার করে আজকাল আমাদের দেশে যেমন ভূরি ভূরি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খোলা হচ্ছে, তেমন ব্যবসাবুদ্ধি সে দেশেও কম নেই। খবর নিয়ে জানা গেল ‘সেরা’ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেই শুধু মনোনীত করা হয়নি, একই খেতাব দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রামের আরও দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভিএএসইউ) কর্তৃপক্ষও এ রকম চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে।
কিন্তু স্বীকৃতি বা খেতাব দেওয়ার তো কিছু পদ্ধতি আছে। যেমন স্বীকৃতিদাতা প্রতিষ্ঠান শুরুতেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। পরে তা যাচাই-বাছাই করা হয়। তা ছাড়া এ ধরনের স্বীকৃতির বিষয়ে সাধারণত প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়। সেখান থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠানোর কথা। এ ক্ষেত্রে সে রকম কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি বলেই স্বীকৃতিদাতা সংস্থাটির উদ্দেশ্য সম্পর্কেই সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস মাহফুজুল বারি বলেছেন, ‘আমার ব্যক্তিগত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-মেইল ঠিকানায় চিঠিটি পেয়েছি। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি। কারণ, এর আগেও এ রকম একটি চিঠি পেয়েছিলাম। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নিবন্ধনের কথা বলে নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি দাবি করা হয়। এই চিঠিতেও সেভাবে বলা হয়েছে।’
চুয়েটের উপাচার্য মো. জাহাঙ্গীর আলমের কথায়ও উঠে এসেছে স্বীকৃতিদাতা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সন্দেহ-অবিশ্বাসের কথা। তিনি বলেছেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি বা পুরস্কার দিতে হলে সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়।... এ ব্যাপারে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমার মনে হচ্ছে কোনো এজেন্সি এভাবে প্রতারণা করছে।’ (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট)।
দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন ‘অক্সফোর্ড সামিট অব লিডারস’ নামের আয়োজনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে তাদের প্রস্তাবকে পাত্তাই দিলেন না, সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য কেন এই তথাকথিত স্বীকৃতিতে বিগলিত? কেন পত্রপত্রিকায় ‘কৃতিত্বের’ সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন—এর উত্তর আমরা জানি না। শুধু অনুমান করতে পারি, নানা কারণে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়ে ‘ভাবমূর্তি’ সংকটে ভুগছেন উপাচার্য। স্বীকৃতির সংবাদ প্রকাশ সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের একধরনের চেষ্টা।
উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের গত দুই বছর মেয়াদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০০ শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত ৪০ জন। নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সপ্তাহে ক্লাস নিতে হয় ১০টি, সহযোগী অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা ১২টি এবং প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের জন্য ১৪টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বললেন, ‘এমন অনেক বিভাগ আছে যেখানে শিক্ষকের সংখ্যাধিক্যের কারণে একজনকে সপ্তাহে তিনটি ক্লাসও নিতে হয় না, সেখানে বিজ্ঞাপিত পদের বেশি শিক্ষক নিয়োগের পেছনে অন্য কোন কারণ আছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।’ এ ব্যাপারে ইউজিসির তদন্ত দাবি করে ওই শিক্ষক বলেন, ‘প্রতিটি বিভাগে কার কটি ক্লাস নিতে হয়, ইউজিসির পক্ষ থেকে এই সহজ হিসাব জানতে চাইলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ শুধু নয়, প্রার্থীদের যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই উপাচার্যের আমলে। যোগ্য প্রার্থীর যেখানে অভাব নেই, সেখানে শর্ত শিথিল করে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার কারণ বোধগম্য হয়নি অনেকের কাছেই। পরে অবশ্য শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে শর্ত শিথিলের ব্যাপারটি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তত দিনে শিথিল শর্তে নিয়োগ পেয়ে গেছেন অন্তত ৪৩ জন শিক্ষক।
শুধু নিয়োগের ক্ষেত্রে নয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নানান অনিয়মের কথা শোনা যায়। অর্থের বিনিময়ে বিদেশি জার্নালে প্রবন্ধ ছাপিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে। সম্প্রতি ইতালি থেকে প্রকাশিত মেডিটারেনিয়ান জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স নামের একটি জার্নালে অল্প সময়ের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের একক ও যৌথভাবে লিখিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় জার্নালটির মান ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কারণ, হঠাৎ করে ‘আন্তর্জাতিক মানের প্রবন্ধে’র এই সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের পাকিস্তান জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স নামের জার্নালটির কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০০৩-২০০৫ সালের দিকে এই জার্নালে লেখা ছাপিয়ে জামায়াত-শিবিরের বেশ কিছু সমর্থক শিক্ষক পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এই জার্নালসহ আরও কয়েকটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তত দিনে যাঁরা কার্যসিদ্ধি (পদোন্নতি) করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের গায়ে আঁচড় লাগেনি।
‘সেরা ব্যবস্থাপকে’র স্বীকৃতিধন্য উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম সম্পর্কে অভিযোগ আছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নির্বিচারে নিজের গ্রাম-জেলা ও উপজেলার মানুষকে চাকরি দিয়েছেন। তবে তাঁর যে কাজটি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে তা হচ্ছে নিজের পুত্র, পুত্রবধূ ও শ্যালিকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া। এ ব্যাপারে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য বলেছেন, ‘যদি তাঁরা (ছেলেসহ আত্মীয়স্বজন) বাংলাদেশের নাগরিক হন এবং যোগ্যতাসম্পন্ন হন, তাহলে তো তাঁরা অপরাধ করেননি।’ (প্রথম আলো, ৫ জুন)।
তাঁদের ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ প্রমাণের জন্য উপাচার্যকে কী পরিমাণ নিয়মের ফাঁকফোকর খুঁজতে হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, নিজের মেয়াদকালে গ্রাম-জেলা-উপজেলা ও সর্বোপরি পরিবারের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নিয়ে আর যা-ই হোক, নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রমাণ করা যায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার মান নিয়ে সচেতন শিক্ষক মহলে যেমন, তেমনি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মনেও সৃষ্টি হয়েছে গভীর হতাশা। নামসর্বস্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ‘সেরার’ খেতাব সেই হতাশা দূর করতে পারবে বলে মনে হয় না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.