ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে সরকার। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মানীর অর্থের কর অব্যাহতির বিষয়ে অনুমোদন না নেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে।
সরকারের সঙ্গে এই নোবেল বিজয়ীর চলা টানাপড়েনের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার এ ঘোষণা এলো। গতকাল সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে এনবিআর-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। আর ব্যাংকিং-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাপারে কোন বিষয়ে মতামতের প্রয়োজন হলে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেয়া হবে। গতকাল ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় ওয়েজ আর্নারের সুবিধা গ্রহণ করে কি পরিমাণ অর্থ দেশে এনেছেন এবং তা থেকে কর অব্যাহতি গ্রহণ বৈধ হয়েছে কিনা- এ বিষয়ে এনবিআরের প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে কবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, তার দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি। ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, মন্ত্রিসভার বৈঠকে এনবিআর তাদের অবজারভেশনে বলেছে, প্রফেসর ইউনূস বিভিন্ন সময়ে ও উপলক্ষে বিদেশে গিয়েছেন। সম্মানী, পুরস্কার ও রয়্যালিটি বাবদ বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন। ওয়েজ আর্নার হিসেবে তিনি এতে আয়কর অব্যাহতি নিয়েছেন। ২০০৪ সালের জুন থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ১৩৩টি বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানী, ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার এবং ১৩টি বই থেকে রয়্যালিটি পেয়েছেন। এ বাবদ মোট ৫০ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৮৮ টাকা করমুক্ত আয় হিসেবে আয়কর নথিতে দেখিয়েছেন। এর বিপরীতে কর অব্যাহতি পেয়েছেন ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৭ টাকা। এনবিআর তাদের প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ কলামে বলেছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ড. ইউনূস একজন পাবলিক সার্ভেন্ট। এ কথাটি ব্যাপক। পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়ার আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই তিনি বিদেশ গিয়েছেন। বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুর্বানুমতি না নেয়ায় বিদেশে যাওয়ার পর উপার্জিত অর্থ এবং উপার্জিত অর্থের ওপর করমুক্ত সুবিধা নেয়া বিধিসম্মত হয়নি। আয়কর অব্যাহতি গ্রহণ বিধিসম্মত হয়নি। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর মুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। তবে গ্রামীণ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আয়করমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়নি। ড. ইউনূস তার পরিচালনাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আয়কর অব্যাহতি নিয়েছেন। এটা বিধিসম্মত হয়নি। তৃতীয়ত, এনবিআরের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্রফেসর ইউনূস তার আয়কর রিটার্নে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেননি। তাকে যেসব শর্তে আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল ওই সব শর্ত ভঙ্গ করেছেন। যারা এই রিটার্ন তৈরি করেছেন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস দায় এড়াতে পারেন না। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এনবিআর ড. ইউনূসের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় পেয়েছে, যা এনবিআর সংশ্লিষ্ট নয়। তবু তারা অনুসন্ধান করতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর একটি, ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে এবং গ্রামীণ কল্যাণ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করেছেন। এটিও বিধিসম্মত নয়। তিনি বলেন, চুক্তিভিত্তিক চাকরির শর্ত অনুযায়ী কেউ যদি চুক্তির অতিরিক্ত সময় পদে থাকেন, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন। কিন্তু অন্যান্য সুবিধা পাবেন না। কিন্তু ড. ইউনূস অন্যান্য সুবিধাও নিয়েছেন। এটিও বিধিবহির্ভূত হয়েছে। এছাড়া, অধ্যাপক ইউনূস তার প্রতিষ্ঠান থেকে পারিবারিক ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। এটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান নয়, তাই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে বলেও এনবিআরের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মামলা করার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। কবে নাগাদ ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ বিষয়ে কোন দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর আগে ২০১২ সালের ২রা আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে ওয়েজ আর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কিনা, এনে থাকলে কি পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন ওই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য এনবিআরকে নির্দেশ দেয়া হয়। প্রায় এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ওই প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় এনবিআর।  সেই প্রতিবেদনে শুধু ড. ইউনূসের করের তথ্য নয়, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলছে কিনা- এসব বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।

ড. ইউনূসের অনিময় খুঁজতে ও জানাতে বললেন প্রধানমন্ত্রী
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে আর কি কি অনিয়ম করেছেন তা খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, যার জন্য (ড. ইউনূস) এত কিছু করলাম তিনিই আমাকে টার্গেট করেছেন। এ কারণে তার জীবনের সব অনিয়ম খুঁজে বের করা দরকার। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দেন বলে একাধিক সিনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তারা জানান, সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি যখন আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন তাই তিনি কি কি অনিয়ম করেছেন, কি কি সমস্যা আছে সব বের করা হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই আমাদের কাছ থেকে তিনি সর্বাধিক সুবিধা নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের লোকেরাও তার পক্ষে প্রচার চালিয়েছে। গ্রামীণকে দাঁড় করানোর জন্য আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছি। আর তিনি আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি নেমে পড়েছেন। আগামীতে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে তিনি সে চেষ্টা করছেন, আমাদের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন। তার অনিয়মগুলো বের হয়ে আসুক, মানুষ জানুক। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অংশ নেন। তারা বলেন, ড. ইউনূসের সবকিছু বের হয়ে আসা উচিত। তাহলে মানুষ তার আসল রূপ জানতে পারবেন। এটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে।
শিগগির ব্যাখ্যা চাওয়া হবে : এনবিআর চেয়ারম্যান
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। মন্ত্রিসভায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর সোমবার সন্ধ্যায় এনবিআর চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কর ফাঁকির বিষয়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে শিগগির ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। ব্যাখ্যায় এনবিআর সন্তুষ্ট না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর প্রয়োজনে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেবে এনবিআর। তিনি বলেন,  গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কর সংক্রান্ত যে সব অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করা হবে। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের অন্য যে সব বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা সরকারের অন্য সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। আমরা শুধু আয়কর সংক্রান্ত বিষয়টি দেখবো। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বিদেশ থেকে কোন সম্মানী, পুরস্কার বা রয়্যালিটি নিতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগে। ড. ইউনূস বিদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আনেন, তার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নেননি, এমনকি গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদকেও তা অবহিত করেননি। কাজেই তার এ আয় আইনবহির্ভূত। এজন্য ওই আয়কে নিয়মিত করতে হবে বলেও জানান গোলাম হোসেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৯৭ টাকা কর ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের ফাঁকির বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ব্যাংকিং বিভাগকে দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের জানান, এনবিআর অনুসন্ধান করে দেখেছে, ড. ইউনূস তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে বিদেশে গেছেন। সেখানে ১৩৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সম্মানী গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার এবং ১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে রয়্যালটি পেয়েছেন, যার মোট মূল্য ৫০ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৮৮ টাকা। এ আয়ের কোন কর দেননি ড. ইউনূস।

No comments

Powered by Blogger.