শিক্ষার্থীদের সিমকার্ড দেয়ার উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক? by মোঃ মুজিবুর রহমান

রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক মুক্তিযোদ্ধা ও এসএসসি পরীক্ষায় সব জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে মোবাইল সংযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বলে ২৯ আগস্ট যুগান্তরে একটি খবর বেরিয়েছে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, টেলিটকের এ পরিকল্পনার আওতায় ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৭০ হাজার জিপিএ-৫ প্রাপ্তকে বিনামূল্যে টেলিটকের সিমকার্ড দেয়া হবে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে টকটাইমও ফ্রি দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নাকি বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে টেলিটক কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে কয়েক দিন আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টেলিটকের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদের ৩০০ সদস্যকে থ্রিজি সিমকার্ডও দেয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে টেলিটক সিমকার্ড ও ফ্রি টকটাইম দেয়ার যে কর্মসূচি কোম্পানিটি হাতে নিয়েছে সেটা প্রশংসনীয়। এ ধরনের কর্মসূচির জন্য আমরা টেলিটক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে পারা যেমন গৌরবের ব্যাপার, অন্যদিকে অসহায় ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা মোবাইল সিমকার্ড ও ফ্রি টকটাইম পেয়ে অনেকখানি উপকৃত হবেন বলে মনে করি। এ সুযোগে সুপারিশ রাখব, মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে সিমকার্ড ও প্রতি মাসে ফ্রি টকটাইম দেয়ার পাশাপাশি টেলিটক যেন তাদের প্রত্যেককে একটি করে হ্যান্ডসেট দেয়ার ব্যবস্থা করে। তাহলেই মুক্তিযোদ্ধারা বিনামূল্যের সিমকার্ড ও ফ্রি টকটাইমের প্রকৃত সুফল পাবেন। আর শুধু ৩০০ জনকে কেন, এটা কি বাড়ানো যায় না?
এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে ফ্রি সিমকার্ড তুলে দেয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক। টেলিটক কী উদ্দেশ্যে এসএসসি পাস অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনের সিমকার্ড দেয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। যারা সবেমাত্র এসএসসি পাস করেছে, তাদের কারও বয়স ১৬ বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। অন্তত এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিয়ম অনুসারে তাদের বয়স এ রকমই হওয়ার কথা। কাজেই যাদের বয়স এখনও ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি, তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ বয়সের শিক্ষার্থীদের টিনএজ শিক্ষার্থী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই টিনএজরা অনেক কিছুই করে থাকে আবেগপ্রবণ হয়ে। এটা তাদের দোষ নয়। এ বয়সীদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য অনেকটা এ রকমই হয়ে থাকে। এ অবস্থায় অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়াটা সুবিবেচনার কাজ হবে বলে মনে হয় না। এছাড়া মোবাইল ফোনের সিম ক্রয়ের ব্যাপারেও বয়সের একটা ব্যাপার রয়েছে। সিমকার্ড ক্রয়ের সময় গ্রাহককে যে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করতে হয় তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, গ্রাহকের বয়স ১৮ বছরের কম হবে না। এক অপারেটরের গ্রাহক নিবন্ধন ফরমে দ্রষ্টব্য অংশে লেখা রয়েছে, বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে। খোদ টেলিটকের রেজিস্ট্রেশন ফরমে সিমকার্ড ব্যবহারকারীর জন্মতারিখ লেখার পাশাপাশি বয়সও লিখতে হয়। এখানে ন্যূনতম বয়সের নির্দেশনা হিসেবে Not below 18 years কথাটা উল্লেখ রয়েছে। আবার গ্রামীণফোন অপারেটরের ওয়েবসাইটে বয়সসীমা প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে, গ্রামীণফোনের ওয়েবসাইটটি এবং এর অন্তর্ভুক্ত যে কোনো পেইজ, তথ্য সার্ভিস ও সেবা ১৮ বছরের কম বয়সী কারও ব্যবহারের জন্য নয়। যে কোনো ধরনের কেনাকাটা বা পণ্য ও সেবা ব্যবহারের জন্য কোম্পানির সাইটে রেজিস্ট্রেশন করে নিজেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের বলে সম্মতি জানাতে হবে। বয়স নিয়ে টেলিটক তাদের সাইটে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা রেখেছে কি-না, সেটা অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করি, নিজ নামে সিমকার্ড ক্রয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়ই বয়সের একটা সীমারেখা রয়েছে। কোনো কোম্পানি নিশ্চয়ই অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোবাইল সিমকার্ড তুলে দিতে পারে না। আর যদি বয়সের ব্যাপারে বাংলাদেশে কোনো আইন-নিয়ম না থেকে থাকে তাহলে আমরা বলব, মোবাইল ফোন গ্রাহকের বয়স অবশ্যই সর্বনিু ১৮ হওয়া উচিত। টেলিটকের সিমকার্ডটি যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর পিতা-মাতা বা অভিভাবকের নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়, সেখানেও কথা থেকে যায়। আমরা শুধু বলব, টেলিটক এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াকে উপলক্ষ করে বিপুলসংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর হাতে ফ্রি সিমকার্ড তুলে দেয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রচলিত আইন ও নিয়মের কোনো লংঘন হচ্ছে কি-না, সেটা কর্তৃপক্ষকে খুঁজে দেখতে হবে।
টেলিটক যে অনেক দূরদর্শী চিন্তা করে মাত্র ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিনামূল্যে সিমকার্ড দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে ৭০ হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর হাতে বিপুলসংখ্যক সিমকার্ড তুলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা আর কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। টেলিটক কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানে, মুক্তিযোদ্ধারা নেহাত প্রয়োজন না পড়লে ফোনে কথা বলবেন না। আমার ধারণা, একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই গভীর রাতে ফোন ব্যবহার করেন না। কিন্তু টিনএজ শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিনামূল্যের সিমকার্ড পেয়ে এবং কমরেটের সুযোগে গভীর রাতে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। আমরা বুঝি না, এমন কী কথা থাকতে পারে যে গভীর রাতে বলার প্রয়োজন? আর বিনামূল্যে সিমকার্ড দেয়ার মানে হল, অভিভাবকদের ওপর একটি করে হ্যান্ডসেট কিনে দেয়ার অতিরিক্তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেয়া এবং এই অতিরিক্ত খরচের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রতিদিন কথা বলার জন্য বাড়তি টাকা গোনা। যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিনামূল্যে সিমকার্ড দেয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, সুতরাং কোম্পানির এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের কাছে কথা বলার খরচ হিসেবে বাড়তি টাকা দাবি করার নৈতিক অধিকার পেয়ে যাবে। আর তারা যখন-তখন বায়না ধরবে এই বলে যে, কথা বলার খরচ না দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি কেন তাদের বিনামূল্যে সিম দিয়েছে। তখন অভিভাবকরা কী জবাব দেবেন, সেটা আমার জানা নেই। তবে অনুমান করি, টিনএজ সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের পোহাতে হবে সীমাহীন বিড়ম্বনা। এটা নিয়ে অনেক পরিবারে সৃষ্টি হবে নতুন আরেক অন্তহীন সমস্যার। টেলিটক কর্তৃপক্ষ যদি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সেবামূলক কিছু করতে চায় তাহলে সেটা অন্যভাবেও করতে পারে। কোম্পানিটি ইচ্ছা করলে জিপিএ-৫ পাওয়া সব শিক্ষার্থীকে পড়ালেখায় উৎসাহ প্রদানমূলক সংবর্ধনা দিতে পারে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ালেখা করার জন্য বইপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের উদ্দেশ্যে এককালীন আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। এছাড়া আরও নানাভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবান্ধব ও সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। এসব শুধু টেলিটক কোম্পানি নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ভেবে দেখতে পারে। তাহলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে উপকৃত হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

No comments

Powered by Blogger.