মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে বৈষম্যও by ড. আর এম দেবনাথ

রাজনীতির বাজার ভালো নয়, নয় অর্থনীতির বাজারও। নির্বাচন সমাগত। নির্বাচনী প্রচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করবে কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এক গভীর অনিশ্চয়তা সর্বত্র। এদিকে অর্থনীতির খবরও ভালো নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু আগস্ট মাসে প্রায় দুবছরের মধ্যে সর্বনিু রেমিটেন্স এসেছে, যার ওপর নির্ভরশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ঈদের পরে রেমিটেন্স একটু কমই হয়। কিন্তু এবার রেমিটেন্স হ্রাসের খবর ভিন্ন। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান তেজী। ৮৪ টাকায় যে ডলার বিক্রি হতো তার মূল্য সরকারিভাবে ৮০ টাকার নিচে। কিন্তু কার্ব বা দুই নম্বরি মার্কেটে ডলারের দাম বেশি। হুন্ডিতেও তাই। এ কারণে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে হুন্ডিতে, সরকারি চ্যানেলে কম। হুন্ডিতে প্রেরকরা ২ থেকে ৪ টাকা প্রতি ডলারে বেশি পায়। অতএব রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে সরকারি চ্যানেল কিছুদিন তেজী থেকে এখন আবার মন্দায় ডুবছে। এদিকে আমদানির পরিমাণ সর্বনিু। ২০১১-১২ অর্থবছরের তুলনায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে নিট আমদানি হ্রাস পেয়েছে। চালের আমদানি, গমের আমদানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এটা যেমন সুখবর, আবার মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে এটা দুঃসংবাদ। এতে সরকারের রাজস্ব কমেছে, কম থাকার আশংকা দেখা দিয়েছে। শেয়ারবাজার ওঠে-নামে, স্থিতিশীল হচ্ছে না। এতসব খারাপ খবরের মধ্যে অবশ্য একটা ভালো খবরও আছে। খবরটি আশাজাগানিয়া।
খবরটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় আয় তথা জিডিপি বেড়ে গেছে। জিডিপির পরিমাণ বৃদ্ধি ও জিডিপি বৃদ্ধির হার সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিগত বাজেট বক্তৃতার সময়ে আমাদের একটা ধারণা দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, সেই হিসাব এখন আর ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এ হিসাবে আমাদের মাথাপিছু আয়ও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা হয়েছে তিনটি কারণে। প্রথমত, হিসাবের ভিত্তি বছর পরিবর্তন হয়েছে; দ্বিতীয়ত, এর ফলে মূল্যমানে পরিবর্তন হয়েছে এবং তৃতীয়ত, জিডিপির হিসাবে নতুন নতুন অনেক পণ্য ও সেবা যোগ হয়েছে, যার ফলে জিডিপি বা অর্থনীতির আকার (সাইজ) অনেক বড় হয়েছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে যে হিসাব করা হতো, সেই হিসাবে জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪,৩৩৭ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন সমান এক হাজার মিলিয়ন)। এখন থেকে ভিত্তি বছর ১৯৯৫-৯৬ অকার্যকর, চালু হয়েছে ২০০৫-০৬। নতুন ভিত্তি বছর ধরে জিডিপির পরিমাণ হয়েছে ৭,২০৪ বিলিয়ন ডলার। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয়। প্রবৃদ্ধির হার ২০১২-১৩ অর্থবছরে নতুনভাবে হবে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা আগের হিসাবে ছিল ৬ দশমিক ০৩। উল্লম্ফনটা হয়েছে খুবই বড় মাথাপিছু আয়ে। এক লাফে এক হাজার ডলারের উপরে হয়েছে মাথাপিছু আয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আগের হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ৯২৩ ডলার। নতুন হিসাবে হয়েছে ১০৪৪ ডলার। এক হাজার ডলারের উপরে হচ্ছে মাথাপিছু আয়- এই হচ্ছে আসল খবরটা।
আমাদের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এটা একটা মাইলস্টোন। এক হাজার ডলার মাথাপিছু আয় অতিক্রম করাই ছিল একটা কঠিন কাজ। এ কাজটা দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে জিডিপির বা অর্থনীতির কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে। আমাদের অর্থনীতি এখন অনেকটা সাবালক। বিগত ৪০-৪২ বছরের ইতিহাস আর টানলাম না। গত দশ বছরেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বহু শিল্প পেছনে পড়ে গেছে। বহু শিল্প নতুনভাবে হয়েছে। অনেক শিল্প মরিমরি অবস্থায় আছে। কৃষি খাতে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন পণ্য যোগ হয়েছে। অনেক কৃষিপণ্যের গুরুত্ব নষ্ট হয়েছে। সেবা খাতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন সেবা। আগে জিডিপি হিসাব করার সময় এসব বিবেচনায় আনা হয়নি। এর ফলে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার প্রভৃতির প্রকৃত প্রতিফলন হয়নি। ভারতে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিংয়ে এসব পরিবর্তন যোগ-বিয়োগ করে নতুনভাবে হিসাব করা হয়, যাতে হিসাব প্রকৃত তথ্যের প্রতিফলন ঘটায়। আমাদের এখানে তা ১০ বছর অন্তর অন্তর করা হয়। তাও করা হয় জাতিসংঘ কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি অবলম্বন করে। এখানে হিসাবটি নির্ভুল করাই মুখ্য লক্ষ্য, রাজনীতি নয়। দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে বিগত দশ বছরে ২৫-৩০টি কৃষিপণ্য নতুনভাবে এসেছে যেমন- সবুজ কলা, সবুজ পেঁপে, সবুজ নারকেল, সয়াবিন, শসা, গোলাপ ফুল ইত্যাদি। আবার শুকনা মাছ ইত্যাদিও আছে, যা যোগ হচ্ছে এখন। শিল্প ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গ্যাস রিফাইনিং কার্যক্রম এবং শিল্প জরিপের মাধ্যমে উঠে আসা অনেক শিল্প-কারখানা নতুনভাবে জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। আসবাবপত্র নতুনভাবে এসেছে। ইট, কাঠ ইত্যাদি আছে। মোটরযান মেরামত কারখানা, টিসিবির কাজ ইত্যাদি রয়েছে। বেসরকারি খাতের বিশাল ব্যবসা, ক্লিয়ারিং-ফরোয়ার্ডিং, ট্রাভেল এজেন্ট, ইন্টারনেট, কেব্ল অপারেটর, ব্র্যান্ডিং, ইনটেরিয়র ডেকোরেশন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট- এ ধরনের অনেক সেবা ইদানীংকার ঘটনা। পূর্ববর্তী জিডিপি ক্যালকুলেশনে এসবের স্থান ছিল না। কিন্তু এখন দিতে হচ্ছে। কারণ এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন। মাইক্রোক্রেডিট, সমবায় ঋণ, বীমার দালাল ইত্যাদি নতুন ঘটনা। এসবের সংযুক্তির কারণে জিডিপির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমার নিজের ধারণা, এ ছাড়াও ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিংয়ে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যমান। আমাদের দেশে কেউ সঠিক মূল্যের ধারণা দেয় না। প্রকৃত আয়, প্রকৃত ব্যয়, প্রকৃত ভোগ, প্রকৃত উৎপাদন ইত্যাদির খবর, প্রকৃত আমদানি, প্রকৃত রফতানির খবর বের করা এক সুকঠিন বিষয়। আমার সব সময়ই ধারণা ছিল, আমাদের যেভাবে গরিব দেখানো হয়, আমরা প্রকৃত অর্থে ততটা গরিব নই। দারিদ্র্য সীমার নিচের লোকের হিসাবও আমার কাছে নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে কত লোক খেতে-পরতে পারে না তার তথ্য আমরা দেই, সরকার দেয়, কিন্তু তার নির্ভুলতা এখনও প্রশ্ন সাপেক্ষ। গত দুই-তিন বছরের মধ্যে আমি সারাদেশ ঘুরেছি। সর্বত্র আমার একটা প্রশ্ন ছিল আর সেটা হচ্ছে- না খেয়ে কোনো লোক আছে কি-না? কেউ আমাকে বলেনি যে, এখন লোকে উপোস থাকে। এমনকি রংপুরের লোকেরাও আমাকে একই কথা বলেছেন। এ অবস্থায় আমার কাছে সব সময়ই প্রশ্ন ছিল, আমরা আসলে কতটুকু গরিব? এ প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও সরকারি হিসাব মানতে হয়। কারণ সরকারের হিসাবের বিকল্প হিসাব আমাদের কাছে নেই। তাছাড়া আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো আগের অবস্থায় নেই। এ প্রতিষ্ঠানটিও বহু চড়াই-উতরাইয়ের মাধ্যমে আজকে একটি জায়গায় এসেছে। তারা বেশকিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের তথ্যই আমরা সবাই ব্যবহার করি। তাদের হিসাবেই আমরা এখন একটা মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছি। এটা বেশ সম্মানের বলে আমি মনে করি। এটা এমন সময় ঘটছে যখন চালে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চালের সংকট আমাদের নেই। চাল আমদানির পরিমাণ নগণ্য। যেটুকু আমদানি হয় তা উচ্চমূল্যের চাল। এখন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হচ্ছে। অধিকসংখ্যক মানুষ চিকন চাল খায়। মানুষ এখন আটার রুটি খায়। স্বাধীনতার পর কেউ আটার রুটি খেলে তাকে গরিব বলে ধরা হতো। পুঁটি মাছ, শোল মাছ, টেংরা, বজরি ইত্যাদি মাছ খেলে মানুষ তাকে গরিব মনে করত। শিম বিচি, কাঁঠাল বিচি, পুঁইশাক ইত্যাদি ছিল গরিবের খাদ্য। এমনকি ইলিশও। এখন এ পরিস্থিতি নেই। এখন গ্রামের মানুষ চা ও কফি নিয়মিত খায়। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হচ্ছে গ্রামে। চারদিকে পরিবর্তন লক্ষণীয়।
আমরা এমন সময়ে মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি, যখন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সম্মানজনক পর্যায়ে। এখন আমরা ঋণ করি বেশি, সাহায্য পাই কম। আমদানি ও রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি। প্রায় এক কোটির মতো বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছে। এরা অর্থনীতির লাইফলাইন। পোশাক কারখানায় কাজ করে ৩০-৪০ লাখ নারী শ্রমিক। ৫৪টির মতো ব্যাংক দেশে। ২০-২৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬০টির উপরে রয়েছে বীমা কোম্পানি। রমরমা একটি বেসরকারি খাত হয়েছে। এনজিও রয়েছে কত তার হিসাব কেউ জানে না। মানুষের গড় আয়ু যথেষ্ট বেড়েছে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। ফসল লাগানো, ফসল তোলা, আগাছা দূরীকরণ থেকে শুরু করে অনেক কৃষিকাজ এখন যন্ত্রে হচ্ছে। গ্রামে শ্রমিকের ভীষণ অভাব। বিশাল একটা আবাসন শিল্প হয়েছে। ৬০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। ৩০-৪০টি মেডিকেল কলেজ আছে বেসরকারি খাতে। এসবই কিন্তু জিডিপির আকার বৃদ্ধির লক্ষণ। আমাদের গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) শুধু আকারে নয়, প্রকারেও বৃদ্ধি পেয়েছে। গুণগতভাবে, কাঠামোগতভাবেও সম্প্রসারিত হয়েছে।
তবে একটি জায়গাতেই সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। এই যে অহংকার করার মতো তথ্য- আমাদের মাথাপিছু আয় ১০৪৪ ডলার- এটা হচ্ছে গড় হিসাব। এতে একজন শ্রমিকের আয় যেমন আছে, তেমনি আছে একজন মধ্যবিত্তের আয়। সর্বোপরি রয়েছে বিদেশে যেসব বাংলাদেশীর বাড়িঘর ও ব্যবসা আছে তাদেরও আয়। বড় বড় ব্যবসায়ী গ্র“পের মালিক, ব্যাংক মালিক, বীমার মালিক, বেসরকারি বিদ্যুৎ কারখানার মালিক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকের আয়ও আছে। বড় বড় উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, কনসালট্যান্ট, মন্ত্রী-মিনিস্টার, সংসদ সদস্য- সবার আয়ই এর মধ্যে আছে। এর অর্থ, গড়ের আয়ে আমাদের বেশ ধনী ধনী ভাব হলেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। আয় বৈষম্য, ধনবৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। অর্থনীতি বড় হচ্ছে, জিডিপি গায়ে-গতরে বাড়ছে, প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, তার পাশাপাশি বাড়ছে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য। আমার ধারণা, এ দিকটিও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমার মনে হয়, আমরা যতটুকু প্রবৃদ্ধির জন্য যতœশীল, ততটুকু বৈষম্য দূরীকরণে নই। এর কিন্তু মূল্য আজ না হোক কাল দিতে হবে। শত হোক, বৈষম্য বড় করে কোনো দেশ অব্যাহতভাবে উন্নয়ন করতে পারে না।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.