কেন তত্ত্বাবধায়ক ভীতি by আহমেদ সুমন

মহাজোট সরকারের শেষ সময় চলছে। শেষ সময় না বলে শেষ মুহূর্ত বলা উত্তম। কারণ এ সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ আর নব্বই দিনও নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রীতি ও ভীতি দুটিই রয়েছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। দলটি এখন তত্ত্বাবধায়ক ভীতিতে রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই মানুষ আনন্দ-অনুভূতির কথা মনে রাখে কম। দুঃখের চিত্র চোখে-মুখে বেশি ফুটে ওঠে, সে আতংকিত হয়। বিগত প্রায় পৌনে পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ অনেক ভালো কাজ নিশ্চয়ই করেছে। ভালো কাজের বিচার-বিবেচনায় বিএনপির শাসনামলের তুলনায় আওয়ামী লীগ হয়তো এগিয়েও থাকবে। কিন্তু মন্দ কাজ বা দুর্নীতির অভিযোগ থেকে আওয়ামী লীগ মুক্ত নয়। অনেকেই বলেন, বিএনপির সময়ে দুর্নীতি হয় সরকারের মধ্যস্তরে কিংবা আরও নিচের স্তরে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের সময়ে দুর্নীতি হয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উল্টো দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের করুণ পরাজয়ের পর মন্ত্রীরা জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ভালো কাজের প্রতিদান এভাবে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু এ কথা কে অস্বীকার করবে যে, ভালো কাজ করা সরকারের দায়িত্ব। মন্দ কাজ জনসাধারণ দেখতে চায় না। ভালো কাজের জন্য বাহবা পাওয়া না গেলেও মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার অনিবার্য। শেয়ারবাজারে পুঁজি খাটিয়ে বিনিয়োগকারীর মাথায় হাত, হলমার্ক কেলেংকারিতে জনগণের অর্থ লুটপাট, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের পিছুটান, রেলের কালো বিড়াল, নিশ্চল কয়েক কোটি টাকার ডেমু ট্রেন এখন জনসাধারণের চোখের সামনে। মহাজোট সরকারের উন্নয়ন এসবের পেছনে পড়ে গেছে। ধারণা করি, এসব তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। আর রয়েছে বলেই তত্ত্বাবধায়কের ভীতি আওয়ামী লীগকে ধাওয়া করছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের যে পরাজয় শুরু হয়েছে, তা আর পিছু ছাড়েনি। আবার এটাও ঠিক, মানুষমাত্রই মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার আকুতি জানায়, বাঁচতে চেষ্টা করে। আমার অবস্থা ভালো নয়, আমি মরে যাই- এমন কথা কাউকে বলতে শুনিনি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র বিদেশ থেকে এদেশে এসে যখন বলেন, তার কাছে তথ্য আছে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই সরকার পরিচালিত জনমত জরিপের ফলাফলেরও। কারণ সরকারি লোকেরা সরকারের মন ভেঙে যেতে পারে, এমন তথ্য সরবরাহ করে না। সরকারের জয়গান করাই তাদের কাজ।
ইতিহাস পঠনে তিন ধরনের শিক্ষার কথা বলা হয়। এক. মানুষ অপরজন থেকে শুনে শিক্ষা গ্রহণ করে। দুই. অপরজনকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তিন. নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, শেষোক্ত অর্থাৎ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। বস্তুত এই শিক্ষাটি খুব পেইনফুল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ইচ্ছা বা অভিমতের বাইরে গিয়ে সরকার যদি কোনো কিছুতে অনড় থাকে এবং এতে যদি সরকারের পতন হয়, সেক্ষেত্রে পুনর্বার সরকারের দায়িত্বে আসা তার পক্ষে বেশ কঠিন। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির অস্থিরতার মধ্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তনের দাবিটি মুখ্য। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের দাবি। অথচ শেখ হাসিনা সরকার এটি জেনে-বুঝেও মানতে চাইছে না। এর কারণ যে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার আশংকায় তত্ত্বাবধায়কের ভীতি আওয়ামী লীগকে পেয়ে বসেছে, তা লুকোছাপা নয়।
বাংলাদেশের জনসাধারণ নির্বাচন এলে সঠিক রায় দিতে এখন পর্যন্ত ভুল করেনি। ভুল করে সরকার। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি সরকার গঠন করেই মধুচন্দ্রিমায় বেহুঁশ থাকে। হুঁশ আসে নির্ধারিত মেয়াদের মাসছয়েক আগে। তখন আর কিছু করার থাকে না বলে কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন করলে পুনরায় ক্ষমতায় আসা যায়, সেই ছলচাতুরিতে নির্দিষ্ট মেয়াদই শেষ হয়ে যায়। ফলে তার পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব হয় না। আমরা লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগও এর ব্যতিক্রম নয়। শেষ পরিণতিতে আওয়ামী লীগের কী হয়, তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে।
আহমেদ সুমন : গবেষক ও বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.