বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অপপরিকল্পনার শিকার by ড. আবদুল হাকিম সরকার

শোকাবহ আগস্ট মাস কতটা দুঃখের, মর্মবেদনার ও ঐতিহাসিক দিক থেকে কলঙ্কময় তা সচেতন মানুষমাত্র অনুভবে না এনে পারেন না। ১৫-এর কালরাত্রি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এ কথা সচেতন-অর্ধসচেতন সবাই স্বীকার করবেন। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এক অপপরিকল্পনার আওতায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এই মহাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। নির্দিষ্ট এই দিনটি বেছে নেয়ার পেছনে পাক-ভারত-বাংলাদেশের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার যোগসূত্র থাকলে থাকতেও পারে। সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগ তথা ওই সময়ের বাকশাল কাঠামোতে অন্তর্দলীয় কোন্দল এ নৃশংস ঘটনার জন্য দায়ী। এ ধরনের উক্তি তর্কের খাতিরে সত্য হিসেবে ধরে নিলে বলতে হয়, অদৃশ্য কোনো সুতা দ্বারা পুতুল নাচিয়ে সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে ওই অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। এটি কি আকস্মিক ঘটনা! ক্রান্তিকালীন অবস্থায় সৃষ্ট নাজুকতায় সুযোগসন্ধানীদের সুপরিকল্পিত ও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার স্বার্থে এক ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অপচেষ্টা এর দ্বারা চালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের জঘন্যতম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সপরিবারে শিশুপুত্র রাসেলসহ জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনা। কেউ বলে, কিছুসংখ্যক পথভ্রষ্ট উচ্চাভিলাষী সৈনিক এ ঘটনা ঘটিয়েছে। কথাটি যতটা সহজ মনে হয়, সম্ভবত বিষয়টি তা নয়। বিষয়টি উপরোল্লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর ঘটনা দ্বিতীয় পর্যায়ের হয়তো প্রথম। প্রথম পর্যায়ের প্রকাশ্য ও আধাগোপন স্বাধীনতা-বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুতে সচল ছিল এবং তা স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে তো বটেই। তবে এই প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক-অপরাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে মিল ও গরমিল দুই-ই আছে। তবে প্রক্রিয়ার বাইরে উদ্দেশ্যের দিক থেকে দুটোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
অপশক্তির পরিকল্পনা অনুসারে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ জেলহত্যার মাধ্যমে এক লোমহর্ষক ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতীয় চার নেতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে লুকায়িত কী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটি কি কাউকে বুঝিয়ে বলার অবকাশ রাখে? কথায় চর্বন করতে হলে বলতে হয়, ‘কারাগার হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান’, জীবনের নিরাপত্তা এর চেয়ে আর কোথাও থাকতে পারে না। অথচ এটিও অপশক্তি ‘তুচ্ছ’ জ্ঞান করেছে। এতে কি এটি প্রমাণিত হয় না, নেপথ্য অপশক্তির ক্ষমতা ও বিস্তার কতটা দূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত!
এভাবে আওয়ামী লীগের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে দুই দশকেরও বেশি সময় লেগেছিল। তাও হয়তো সম্ভব হতো না, যদি বিদেশে অবস্থান করার কারণে দুই বোন দৈবাৎ বেঁচে না যেতেন! তাদের একজন শোকে মুহ্যমান হওয়ার পরও জাতির জনকের রক্তের ঋণ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত না হতে দেয়ার সুতীব্র প্রতিজ্ঞায় ধৈর্য ধারণ করে হাল ধরেন আওয়ামী রাজনীতির। কিন্তু মাঝখানে বইয়ে যাওয়া একুশটি বছর রাজনীতি বিপথে পরিচালিত হয়েছে। যুব-তরুণ সমাজের হাতে অর্থসহ অস্ত্র তুলে দেয়া, সংবিধান কাটাছেঁড়া করে অবশিষ্টাংশকে মূল করে আরও কত কিছু সংযোজন করে তা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, ইচ্ছা করলেও যেন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার পরিবর্তন করতে না পারে। মূল সংবিধানে ফিরে গেলেও যেন আপসকামিতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
বিংশ শতকের শেষ অর্থাৎ ’৯৬-তে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দায়িত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। ততদিনে নানাপক্ষের সম্মিলনে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে আর একটি শক্তির উত্থান ঘটে। যদিও এই উত্থানের বিষয়টি গত ২১ বছরে এভাবে না হয় সেভাবে, একক ও যৌগিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার সাধ ভোগ করেছে; নিজেদের করেছে সমৃদ্ধ, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক চেতনার যোগসাজশে কলেবরে হয়েছে বড়। এ শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই।
বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, আজ শত্র“ হয়েছে আপন, মিত্র হয়েছে হয়তো পর। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বাস্তবে কঠিন হলেও কী করে আদর্শের ভিত্তি সুদৃঢ় করা যায়, তাতে সচেষ্ট থাকতে হবে। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ক্রমধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই হয়ে থাকে। নীতি ও আদর্শে বিপরীতমুখিতা থাকলে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হয় না; লুডু খেলার মতো মই বেয়ে ওপরে ওঠা ও সাপের মুখে পড়লে লেজে নিপতিত হওয়াও বিচিত্র নয়।
ড. আবদুল হাকিম সরকার : উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.