দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসে নষ্ট রাজনীতির থাবা by ফরিদ আহমদ রবি

ঈদের পরদিন একবেলা প্রকৃতির ভেতর হারিয়ে যাওয়ার লোভে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার বন্ধু প্রায়ই বলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সবচেয়ে সুন্দর বর্ষাকালে। এত সবুজ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে টলমল করে লেকের পানি। তাই বর্ষার ক্যাম্পাস দেখার এ সুযোগটা নিয়ে নিলাম। বন্ধুটি নেই। ঈদের ছুটিতে বাইরে গেছে। অবশ্য আমার তাতে অসুবিধা হয়নি। আমার ছেলে অল্প কয়েক মাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এ সুবাদে জাহাঙ্গীরনগরে ওর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে। ঈদে অনেকে বাড়ি চলে গেছে। তবে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হল- আশিক। ধামরাইয়ের দিকে ওর বাড়ি। সে আরও কয়েকজন বন্ধু জোগাড় করে আমাদের জন্য ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করবে। প্রায় জনবিরল ক্যাম্পাসে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেলাম। এদেশে এমন দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস আর আছে কি-না আমার জানা নেই। ছেলের ভর্তির সুবাদে কয়েকবার এসেছি। তবে এমন নিসর্গ আগে চোখে পড়েনি। বর্ষার কারণে লেকের পানি টলটল করছে। এবার ক্যাম্পাসের সব লেক ও পুকুর সংস্কার করায় আরও যৌবনবতী হয়েছে। আমরা মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের দিকে যাচ্ছিলাম। আশিক একটি পানিভরা পুকুর দেখাল। আমি আবার আমার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। আশিক আমাকে থামাল। বলল, আংকেল খুশি হবেন না। আমাদের একদল স্যার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বলেছেন, এভাবে পুকুর কেটে ভিসি সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূদৃশ্য নষ্ট করেছেন। কারণ এর আগে এটি ছিল একটি বাইদ জমি। আগাছা উন্মাত। অথবা কেউ ধান চাষ করত। আমি বললাম, তাতে কী, মানব সভ্যতা তো এভাবেই নিজেকে সাজায়। প্রকৃতি কিছুটা দেয়, তার ওপর মানুষের সৃষ্টিশীল হাতের কারুকাজে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ওঠে। আশিক বলল, আমরাও আমাদের স্যারদের এ কথা শুনে তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রশ্ন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এতসব একাডেমিক বিল্ডিং, হল- এসব হল কেমন করে? এত বড় দাগে ভূদৃশ্য নষ্টের প্রতিবাদে অতীতে কি আন্দোলন হয়েছে? ভূদৃশ্য রক্ষার নামে উচিত ছিল গাছতলায় ক্লাস করা। আশিক বলল, আংকেল আপনি মন ভালো করার জন্য ক্যাম্পাসে এসেছেন। এখন মন খারাপ করার মতো কয়েকটি নমুনাও দেখাব। আমরা জাহানারা ইমাম হল পার হয়ে চলে এলাম ভিসির বাসভবনের কাছে। আশিক দেখাল ভিসি ভবনের সীমানা প্রাচীরের পর থেকে ভবনের সামনের লেককে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে সবুজ রঙ করা এ বেড়াটি সদ্য তৈরি। আশিক জানাল, এই বেড়া ঘিরেও রাজনীতি হয়েছে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এই বেড়া দিয়ে ভিসি তার ভবনের সীমানা বাড়িয়েছেন। কথাটি আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এই ভবনটি নিশ্চয়ই ব্যক্তি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নয়। ভিসি ভবন সমৃদ্ধ হওয়ার মধ্যে অন্যায় কী! আমি স্মৃতিচারণ করলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। আমার বন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। তার বর্ণনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য বিষয় ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ভবন। গর্ব করে বলেছিলেন, আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এতটা জায়গা নিয়ে ভিসি ভবন নেই। আশিক একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল, আপনি বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না। ভিসি তার ভবনের সামনের লেকে সস্ত্রীক নৌকায় মাঝে মাঝে বিহার করেন, তাও নাকি স্যারদের সমালোচনার বিষয়। এ কথাটি অবশ্য আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না। এমন উন্মুক্ত ক্যাম্পাসের মানুষ এতটা সংকীর্ণ নিশ্চয়ই হবেন না।
আশিক ও ওর বন্ধুরা নিয়ে গেল প্রশাসনিক ভবনের সামনে। সেখানে সাদা-কালো নানা ধরনের ব্যানার টানানো। পড়ে বিশ্বাস করতে কষ্ট হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ সহকর্মীর বিরুদ্ধে এমন সব শব্দ চয়নে ব্যানার লেখে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর ব্যানারে প্রতিবাদী শব্দ চয়নে যে সাবধানতা থাকে, শিক্ষকদের ব্যানার তা অতিক্রম করেছে। এমন স্থূলতা দেখব আমি আশা করিনি। আমি আশিকদের বললাম, হাইকোর্ট তো আন্দোলনকারীদের প্রশাসনিক ভবন থেকে হটিয়ে দিয়েছেন, তাহলে এসব কুৎসিত ব্যানার এখানে এখনও টানানো কেন? আশিক হেসে বলল, ভিসি স্যার বোধহয় আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মতো অতটা নিচে নামতে পারেননি। তাই ব্যানার টানানোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করছেন।
এবার আশিক সলজ্জ হাসি হেসে বলল, আংকেল লজ্জা যখন কেটে গেছে তখন আমাদের স্যারদের আরেকটি ছেলেমিসুলভ কীর্তি দেখাই। ও নিয়ে গেল সদ্য সংস্কার করা কয়েকটি পুকুর ও লেকের পাড়ে। সেখানে সিমেন্ট পাথরে একটি করে ফলক স্ট্যান্ড রয়েছে। কালো কাপড় বেঁধে ঢেকে দেয়া হয়েছে ফলক। একটির মধ্যে কাগজ সাঁটা রয়েছে। পড়ে বোঝা গেল ‘অবাঞ্ছিত’ ভিসি যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে জলাশয়ের নামকরণ করেছেন বলে এই শাস্তি। আশিক জানাল, শিক্ষার্থীরা এতে খুব বিব্রত হয়েছে। ভিসির প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ ছাড়া একে আর কী বলা যায়! এবার ফোড়ন কাটল রুবেল অথবা নোভেল ছেলেটি। বলল, আন্দোলনকারী স্যারদের সবই কালো। ব্যানার কালো, নামফলক মুছে দেয়ার কাপড়ও কালো, প্রতিবাদের ভঙ্গি আর ভাষাও কালো। ওদের সামনে আমিও কেমন বিব্রত বোধ করতে লাগলাম।
আমি আশিককে প্রশ্ন করলাম, পত্রিকা পড়ে তো মনে হয়েছে এই আন্দোলনের তেমন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। সব শ্রেণীর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর সমর্থনও নেই। তোমরা কীভাবে দেখছ তোমাদের স্যারদের আন্দোলন? আশিকের মুখে একটি কষ্টের রেখা দেখতে পেলাম। ও বলল, স্যাররা নিজেদের স্বার্থের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজকে ভীষণ সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এখন বাইরে কোথাও নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দেয়ার জো নেই। নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হাইকোর্টের রায়ের আগে আমার কয়েকজন বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিল। বলল, ‘আমরা তোদের স্যারদের পিকেটিং দেখতে এসেছি। তারা নাকি প্রশাসনিক ভবন তালা দিয়ে পালা করে পাহারা দেন?’ ওদের প্রশাসনিক ভবনের পথ দেখিয়ে আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম।
অনেক্ষণ পর মুখ খুলল আশিকের বন্ধু রুবেল অথবা নোভেল। ও ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত। এই ক্যাম্পাসে বরাবরই সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দাপট। তাই এখন ওরা অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এই প্রায় জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলনে বিএনপির শিক্ষকরা জড়িত হয়েছেন দেখে ওর দুঃখ। বলল, বর্তমান উপাচার্য আওয়ামী লীগের মনোনীত। আর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে পদত্যাগকারী আগের ভিসির লোকজন। তারাও আওয়ামী লীগের সমর্থক। আগের ভিসি শরিফ এনামুল কবির নাকি এই ভিসিকে তাড়িয়ে আবার ভিসি হতে চান। তাহলে কামড়াকামড়ি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের। বিএনপি কেন নিজেকে পচাতে গেল। আশিক হেসে বলে, দোস্ত আগামী নির্বাচনে তোমরা নাকি পাওয়ারে আসবে। তাই এই সুযোগে দলীয় নেতাদের চোখে পড়ার জন্য তোমার স্যারেরা কসরৎ করছেন। একটি অদ্ভুত হাসি খেলে গেল ছেলেটির ঠোঁটে। বলল, ঈদের আগে নয়াপল্টনে আমাদের অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ এলো। নেতাগোছের একজন আন্দোলনে যুক্ত বিএনপি শিক্ষকদের সমালোচনা করলেন। বললেন, আনোয়ার সাহেব সরে গেলে সরকার আরেকজন আওয়ামী লীগের শিক্ষককে বসাবেন। বিএনপির জন্য তিনি আনোয়ার সাহেবের চেয়ে ভালো হবেন না। এছাড়া বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে নতুন ধারার পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করবে। অযৌক্তিক আন্দোলনে আওয়ামী শিক্ষকদের সঙ্গে যুক্ত থেকে যারা দলের ইমেজ নষ্ট করছেন, তারা নিশ্চয়ই পার্টির সুনজরে থাকবেন না।
আমি আশিকদের কাছে জানতে চাইলাম, এই আন্দোলন নিয়ে তোমাদের মনোভাব কী? আশিক বলল, আমরা ছাত্রছাত্রীরা দারুণ বিরক্ত। স্যাররা নিজেদের লাভ-লোকসান আর পাওয়া-না পাওয়ার ঝগড়ায় আমাদের শিক্ষা জীবনের ভীষণ ক্ষতি করে দিলেন। অত্যন্ত অনৈতিকভাবে আমাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন। গত গ্রীষ্মের ছুটির আগে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য আমাদের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে দিলেন। প্রায় দেড় মাস আমরা স্যারদের ইচ্ছার হাতে বন্দি হয়ে রইলাম। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় ছিল। সামনে প্রায় সব বর্ষের পরীক্ষা। এটা ছিল ক্লাস ও টিউটোরিয়াল পরীক্ষা শেষ করার সময়। সব আটকে গেল। এই জের টানতে গিয়ে আমরা প্রায় ছয় মাসের সেশনজটে পড়ে যাব। এই ক্ষতির দায় কি আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা নেবেন?
এই দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস দেখতে এসে আমি ও আমার পরিবার ভীষণ কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। এই চমৎকার ক্যাম্পাস জ্ঞানচর্চার তপোবন হতে পারত। নষ্ট রাজনীতির থাবা সে সম্ভাবনাকে কীভাবে বিবর্ণ করে দিচ্ছে। আমরা আমাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাই সুশিক্ষিত হবে এই আশায়। শুধু ক্লাসরুম আর লাইব্রেরি নয়, এই বিশাল ক্যাম্পাস থেকেও নানা জ্ঞানের সঞ্চয় করবে। শিক্ষাগুরু শিক্ষকদের দেখে বড় হওয়ার স্বপ্ন তৈরি করবে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু সেই পথ প্রদর্শন কি করতে পারছেন আমাদের শিক্ষকরা? শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীর আদর্শ। সেই আদর্শের এই বিপন্ন দশা নিশ্চয় জাতির কাম্য নয়। এটি সত্য যে, শিক্ষকদের বড় অংশই সৎ আদর্শ ধারণ করে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু নষ্ট রাজনীতির জগতে হাঁটা অবিবেচকদের কারণে সব শিক্ষককে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, শুভ শক্তির সরব প্রতিবাদের মুখে অশুভ শক্তি বিদূরিত হোক।
ফরিদ আহমদ রবি : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.