উপকূলীয় সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসুন by ড. একেএম নওশাদ আলম

বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, নানা রকম সচেতনতামূলক ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালনের ফলে অভ্যন্তরীণ মাছের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ব্যাপক প্রভাব জনজীবনে লক্ষ্য করা যায়। কয়েক বছর আগে যেখানে বাজারে মাছই পাওয়া যেত না, এখন চাষের মাছ হলেও এবং মাছের বাজারে গুটিকয় প্রজাতির প্রাধান্য থাকলেও বাঙালি মাছ তো খেতে পারছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনের এ সাফল্যের নিরিখে বলা যায়, এ ধরনের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে এবার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ আমাদের দেশে এখনও একটি অবহেলিত উপখাত। অথচ এটা সবার জানা যে, জাতীয় রফতানিতে এ উপখাত থেকেই মৎস্যখাতের সবচেয়ে বেশি অবদান আসছে।
কোনো কালে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক অঞ্চল। দীর্ঘদিন ধরে সম্পদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ও মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উপকূল নিঃশেষ হয়েছে বহু আগেই। যাওবা ধুক ধুক করে অবশিষ্ট ছিল পশ্চিম উপকূলের সুন্দরবনে, ঘূর্ণিঝড় সিডরে তার যে পরিমাণ সম্পদহানি হয়েছে, তা আজও পূরণ হয়নি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লাগামহীন ও অনৈতিকভাবে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় শামিল সরকারি-বেসরকারি উভয়পক্ষ। উপকূলীয় এলাকায় নানা রকম সনাতন ক্ষতিকর জাল ব্যবহার করে একদিকে যেমন পোনা মাছসহ প্রায় সব মাছ ছেঁকে তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে ধারণক্ষমতার অধিক যান্ত্রিক ট্রলার ব্যবহার করে সমুদ্র প্রায় মাছশূন্য করে ফেলা হচ্ছে। এরপরও প্রতিটি সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন নতুন ট্রলারের অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।
উপকূলীয় প্যারাবন কেটে সাফ করে দেয়া হয়েছেÑ যার অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক মূল্য অপরিসীম। এর ফলে মাছসহ অন্য ছোট-বড় সব জলজ প্রাণীর আবাস, খাদ্য ও প্রজননস্থল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে অগভীর জলাশয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং প্রাণীর খাদ্য জোগান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন প্রতিবছর একটু একটু করে বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন না বাড়লেও, পরিমাণগত উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো হলেও ধরা মাছের গুণগতমান বেশ নাজুক। অর্থাৎ ধরা মাছের প্রায় পুরোটাই স্বল্পদামের কিশোর বা ছোট মাছ, যা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বড় হয়ে ডিম পেড়ে আরও অনেক কিশোর মাছ উৎপাদন করতে পারত। একই সঙ্গে বেশি বেশি দেশীয় সনাতন ক্ষতিকর জাল যেমনÑ মোহনা-বেহুন্দি বা সাগর-বেহুন্দি এবং উপকূলের কাছাকাছি যান্ত্রিক ট্রলার বা ধারণক্ষমতার বেশি যান্ত্রিক ট্রলার ব্যবহারের ফলে কিশোর মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ছোট মাছ বেশি ধরাতে মাছের মোট পরিমাণ কখনও কখনও সামান্য হয়তো বাড়ছে, তবে দাম কম পাওয়ায় ছোট থেকে বড় সব মৎস্যজীবীর লাভের অংকে ভাটা পড়েছে। গরিব সনাতন মৎস্যজীবীদের তাতে সংসার চালানোর মতো আয়ের সংস্থান হচ্ছে না, যান্ত্রিক নৌকা বা জালের মালিক-মহাজনদের লগ্নিকৃত পুঁজি উঠে আসছে না, ট্রলারওয়ালাদের ট্রিপ প্রতি লোকসানের পরিমাণ বাড়ছেই। আয় বাড়াতে বা ক্ষতি পোষাতে সব স্তরের মৎস্যজীবীই আরও বেশি মাছ আহরণে নিয়োজিত হচ্ছে। এতে প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়ছে উপকূলীয় জলাশয়।
বঙ্গোপসাগরে আমাদের অংশের তলদেশ, বিশেষ করে সুন্দরবনের লাগোয়া উপকূল থেকে মহীসোপান পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই বালি ও কাদাময়, খুব সামান্য অংশই কঠিন শীলা বা পাথর দ্বারা আবৃত। এখানে অসংখ্য ধারায় মিঠাপানি প্রবাহের ফলে তীর থেকে বহুদূরে গেলে স্বাভাবিক লবণাক্ততাসম্পন্ন সমুদ্রের পানি পাওয়া যায়। বর্ষাকালে নদীতে মিঠাপানি প্রবাহের পরিমাণ বেশি বলে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা হ্রাস পাওয়ার ব্যাপ্তি সাগরের উপরিভাগের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হয়। শীতকালে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় সঠিক লবণাক্ততা উপকূলের খুব কাছেই পাওয়া যায়। পোনা ও কিশোর মাছ উপকূলের কাছাকাছি কম লোনা পানিতে থাকে। মাছ যতই বড় বা পরিণত হতে থাকে, ততই অধিক লবণাক্ত গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকে। তলদেশে বসবাসকারী প্রজাতি তলদেশ ধরে চলাচল করে। অন্যদিকে, দ্রুত সঞ্চরণশীল ভাসমান প্রজাতি পানির উপরিতল ঘেঁষে বা তার সামান্য নিচ দিয়ে চলাচল করে।
আকার, স্বাভাবিক আবাসস্থল ও চলাচল পথের ওপর ভিত্তি করে মাছ সমুদ্রের তলদেশে, অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে অথবা উপরিতলের সামান্য নিচে ডিম পাড়ে। মাছ যেখানেই ডিম পাড়–ক না কেন, নিষিক্ত হয়েই তা পানির ওপরে ভেসে ওঠে। পানির উপরিতলে মাছের ডিম ফুটে প্রথমে রেণুপোনা উৎপন্ন হয়। রেণুপোনা পানির স্রোতে ভেসে ভেসে উপকূলের কাছাকাছি চলে আসে। এখানে তারা বিশ্রাম নেয় ও আকৃতি পাল্টায়, দ্রুত খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে এবং বড় হয়ে আবার গভীর সমুদ্রে নিজস্ব আবাসস্থলে ফিরে যায়। এভাবে মাছের জীবনচক্র চলতে থাকে। উপকূল থেকে বা গভীর সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের ধরে ফেললে বড় হয়ে আবার ডিম দেয়ার মতো মা-মাছ আর থাকল কই? তাই উপকূলে বছরের পর বছর ধরে একই পরিমাণ মাছ আহরণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক্ষেত্রে করণীয় কী? এর জন্য প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত সম্পদ আহরণ, সমুদ্রের গুণগতমান বজায় রাখা এবং সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ থেকে বিরত থাকা, বিশেষ করে দিনদিন কমতে থাকা মাছ বা জলজ প্রাণী আহরণে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা। প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই আহরণে জীববৈচিত্র্যকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ মারাÍকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে মৎস্য বিভাগ ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি উপকূলীয় মৎস্যজীবী, বৃহদায়তন মৎস্য আহরণকারী বা ট্রলার মালিক, ব্যবসায়ী, পুঁজি লগ্নিকারী, প্রক্রিয়াজাতকারী, সম্প্রসারণ কর্মী, গবেষক, উন্নয়ন কর্মীসহ সব সুফলভোগী ও অংশীদার মিলে উপকূলীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এ কাজটি শুরু করার এখনই উপযুক্ত সময়। এখন থেকেই আমরা প্রতিবছর ‘জাতীয় উপকূল সপ্তাহ’ পালন করে সুফলভোগীদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে পারলে এক সময় আবার উপকূলকে মাছে মাছে ভরিয়ে দিতে পারি। আমরা এর জন্য কিছু করণীয় নির্ধারণ করতে পারি। যেমন- উপকূলে মোহনা-বেহুন্দি নিষিদ্ধ করে মোহনা-বেহুন্দির জেলেদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সাগর-বেহুন্দিতে স্থানান্তরিত বা প্রতিস্থাপিত করতে পারি। সাগর-বেহুন্দির জেলেদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে গভীর সমুদ্রে বা একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় লং-লাইনিংয়ের মাধ্যমে টুনা বা অন্যান্য ভাসমান প্রজাতির মাছ আহরণে নিয়োজিত করতে পারি। চল্লিশ মিটার গভীরতার বাইরে যান্ত্রিক ট্রলারের মাছ ধরার আইনের বিধানটি কড়াকড়িভাবে পালন করতে পারি। সরকারি পর্যায়ে আর একটিও বটম বা মিড-ওয়াটার ট্রলার বর্তমান ট্রলার বহরে সংযোজিত না করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞ থেকে সবাই আইনের বিধানের প্রতি একনিষ্ঠ হতে পারি। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ চাষে আকাশ পরিমাণ সাফল্য পেলে উপকূলীয় জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কেন বাড়াতে পারব না? দেশপ্রেমিক মন নিয়ে সবাই মিলে সচেষ্ট হলে অবশ্যই পারব।
ড. একেএম নওশাদ আলম : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

No comments

Powered by Blogger.