জনগণের মর্যাদা ও প্রাসঙ্গিক কথা by মোশাররফ হোসেন মুসা

লেখাটির শুরুতে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। ঘটনাটি একটি প্রত্যন্ত গ্রামের। ওই গ্রামের একটি প্রভাবশালী পরিবারের দুই সন্তান হলেন একজন এমপি ও আরেকজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তারা প্রতি বছর তাদের পিতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বেশ ঘটা করে দোয়া-খয়রাতের আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে খোলা আকাশের নিচে চাটাই বিছিয়ে প্রায় ১০ হাজার গ্রামবাসীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ওই দোয়া-খয়রাতে প্রথম প্রথম গ্রামের লোকজনই অংশগ্রহণ করত। এক সময় শহরের লোকজনও অংশগ্রহণ করা শুরু করে। একবার এমপি তার ছোট ভাইয়ের পরামর্শে দুই রকম প্যান্ডেলের আয়োজন করেন। একটি প্যান্ডেলে চেয়ার-টেবিল পেতে শহরের লোকজন ও সরকারি চাকরিজীবীদের এবং অন্যটিতে চাটাই বিছিয়ে গ্রামের সাধারণ লোকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। একই অনুষ্ঠানে দুই রকম ব্যবস্থা দেখে গ্রামের লোকজন সমালোচনা শুরু করে। তাদের মতে, চাটাইতে বসতে দিয়ে তাদের অমর্যাদা করা হয়েছে। আমলা ভাইটি গ্রামবাসীকে গালাগাল শুরু করলে এমপি সেদিকে না গিয়ে গ্রামবাসীর পক্ষ নেন। তার বক্তব্য, জনগণকে নিয়েই তাকে চলতে হবে, সে জন্য জনগণের অমর্যাদা হয় এমন নিয়ম তিনি রাখবেন না। পরবর্তী বছর থেকে সবার জন্যই চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়। এদেশের জনগণের মর্যাদার প্রতি নজর না থাকার পেছনে রয়েছে দীর্ঘকাল পরাধীন থাকার ইতিহাস। বিদেশী শাসকরা তাদের অর্থনৈতিক শোষণের স্বার্থে স্থানীয়দের ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত ও উঁচু-নীচু শ্রেণীতে বিভক্ত করে রাখত। দেশ স্বাধীন হলেও উপযুক্ত শাসন ব্যবস্থার অভাবে এখনও তাদের কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসেনি। ফলে অনেক সময় তারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেয়ে সাংস্কৃতিক বৈষম্যতে ক্ষুব্ধ হয় বেশি। একই কারণে কখনও কখনও চরম দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিও মিষ্ট আচরণে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অতিকথন ও উদ্ধত আচরণের কারণে সরকারের বহু অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীও জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে বিবেচনায় না নিয়ে মাঝে-মধ্যে বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন- ‘সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অহংকার, দম্ভ আর খামখেয়ালিপনার জবাব দিয়েছে জনগণ।’ আবার কেউ বলেছেন- ‘এগুলো নেতিবাচক ভোট। এ ভোট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হলেও বিএনপির পক্ষে নয়।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা সৎ, ক্লিন ইমেজের এবং উন্নতি করেছেন তারা ভোট পাননি। যারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি আর খুনের সঙ্গে জড়িত, তারাই জিতে এলেন। ... তাহলে আমরা এই উন্নয়ন কেন করছি? কার জন্য করছি? যদি দুর্নীতিবাজরাই জিতে আসে! এই জেতার রহস্যটা কী? ... শুনলাম জাতীয় ইস্যুর জন্য হেরে গেছি। জাতীয় ইস্যু কী? আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারছি কি না! ... জাতীয় ইস্যুর জন্যই যদি হারব, তাহলে আমার প্রশ্ন, জাতীয় ইস্যু হয়ে গেল দুর্নীতি। আমাদের সরকার নাকি দুর্নীতি করেছে, তবে দুর্নীতি করে তো এত উন্নয়ন সম্ভব নয়’ (ইত্তেফাক, ১৪ জুলাই ২০১৩)। আওয়ামী লীগ সমর্থিত কিছু বুদ্ধিজীবীও বিভিন্ন লেখায় অনুরূপ ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন (যদিও প্রধানমন্ত্রী গত ২১ জুলাই পাঁচ মেয়রকে শপথবাক্য পাঠ করানোর সময় দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে তাদেরকে জনসেবায় নিয়োজিত থাকতে অনুরোধ করেছেন)। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ইস্যু ও স্থানীয় ইস্যু বোঝেন না, এটি ভাবা চরম বোকামো হবে। তিনি মাঝে-মধ্যেই সরকারি সফরে উন্নত বিশ্বে যান (ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রায় দশ মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন)। সেখানকার হোটেল, পরিবহনসহ বহু কিছুই স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত রয়েছে। ইংল্যান্ডে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানটিও পরিচালিত হয়েছে স্থানীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে। বলা হয়, এদেশেও স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় সরকারের কোনো স্বাধীনতা নেই। একই কারণে ‘স্থানীয় সরকার’ নামে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। উদাহরণস্বরূপ একটি ড্রেনকে পরিষ্কার রাখলেন, তিনি কালা মিয়া না ধলা মিয়া, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। যিনি পরিষ্কার রেখেছেন তাকেই ভোট দেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয়রা জাতীয় রাজনীতিতে অতিমাত্রায় আক্রান্ত হয়ে পড়ায় স্থানীয় কাজের বিবেচনায় ভোট প্রদান করছেন না। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতারাসহ সরকারি দলের শতাধিক এমপিকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। ফলে স্থানীয় নির্বাচনটি আর স্থানীয়দের থাকেনি, জাতীয় রাজনীতির মহড়ায় পরিণত হয়। এই নিবন্ধের লেখক গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহকে বলেছিলেন, তিনি যেন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলেন- ‘এটি স্থানীয় নির্বাচন। স্থানীয় কাজ আর জাতীয় কাজ এক নয়।’ কিন্তু তিনিও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে করে ভোট প্রার্থনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জয়ী প্রার্থীদের দুর্নীতিবাজ আর সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ভোটারদেরই অবমূল্যায়ন করেছেন। জনগণ শতভাগ বিশুদ্ধ হয় না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারও বিশুদ্ধ হয় না। সে জন্য গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হল জনগণকে শুদ্ধ হওয়ার জন্য সচেতন করে তোলা। টঙ্গী এলাকার জনৈক ভোটার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার যদি উন্নতি করে থাকে তাহলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় করেছে, নিজেদের পকেটের টাকায় নয়। কেউ যদি দুর্নীতি করে থাকে তাহলে সেটাও জনগণের টাকাই।’ আরেকজন ভোটার বলেন, ‘জনগণ ভাত-কাপড় চায়, মর্যাদাও চায়।’ আমার বিশ্বাস, তাদের দু’জনের সরল উক্তি যেন সাধারণ জনগণের বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি। জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের পেছনে রয়েছে মানুষের মর্যাদা দেয়ার চিন্তা। উন্নত বিশ্বে মানুষকে মর্যাদা দেয়ার জন্য পৃথক আইন রয়েছে। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার সুরক্ষার পেছনেও রয়েছে জনগণকে মর্যাদা দেওয়ার চেতনা। ২৮ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ কিন্তু মহান জাতীয় সংসদে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়। মানুষের জন্মস্থান, বংশপরিচয় ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অপচয় করা হয়। অথচ তাদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভিন্ন দেশের ভিন্ন ধর্মের ছেলে-মেয়েদের বিয়েশাদি সম্পন্ন হচ্ছে। তারা ভুলে যান যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, বাচনভঙ্গি ইত্যাদিতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল বলেই সমগ্র জাতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছিল। সরকারপ্রধানের স্ববিরোধী ও ক্ষুব্ধ আচরণ প্রসঙ্গে সরকারদলীয় জনৈক এমপি বলেন, ‘নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মাঝে-মধ্যে ভুল আচরণ করে থাকেন।’ মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তার কথাটি অনেকটাই সত্য। তাই বলে প্রধান নির্বাহী পদে বসে ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে ক্ষুব্ধ আচরণ করে শপথ ভঙ্গ করতে পারেন না।
বর্তমানে বহু বুদ্ধিজীবী বলা শুরু করেছেন- সময়োপযোগী শাসন ব্যবস্থার অভাবে আমরা অসহনীয় পরিবার ও ব্যক্তিতন্ত্রের কবলে পড়ে আছি। সেজন্য একাধিক সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবও নানাভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। বিরোধী দলের কেউ কেউ বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করবেন। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হল- এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ জনগণের ক্ষমতায়ন সম্ভব। যেমন- প্রতিটি জেলাকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে ও স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট করে সব স্থানীয় কাজ এই ইউনিটের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবে ইউনিয়ন হবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিু ইউনিট এবং পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন উভয় হবে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনিু ইউনিট। ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হওয়ায় ও পরিচিত হয়ে পড়ায় প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি সংযুক্ত করে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন- ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি। এ ব্যবস্থায় জেলার প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষও করা সম্ভব। পরিশেষে বলা প্রয়োজন, একটি মাত্র সরকার দিয়ে, তথা উনবিংশ শতাব্দীর সরকারব্যবস্থা দিয়ে সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, এটি এখন দিবালোকের মতো সত্য।
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক ও সদস্য, সিডিএলজি

No comments

Powered by Blogger.