না-লেখার মাঝেও আনন্দ আছে by বদিউর রহমান

৩ জুলাই যুগান্তরে ‘আনারসের হলে জয়, মজাটা কেমন হয়?’ শীর্ষক আমার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকদিন লেখা হয়নি। এর আগে ১৫ জুন প্রকাশিত ‘চার সিটির নির্বাচন কি কোনো পূর্বাভাস দেবে?’ বেশ আলোচিত হয়েছিল। দু’-একজন পাঠক টেলিফোনে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন আমি ‘বাজাদ-মনা’ হয়ে যাচ্ছি কি-না। আলী-মনা আর বাজাদ-মনা নিয়ে চাকরিতে থাকতে বেশ সরব কথাবার্তা সোনা যেত। সরকারি চাকরির জোটীয় আর মহাজোটীয় দলীয়করণে কারা আওয়ামী লীগ (আলী) আর কারা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদ) ঘরানার তা নিয়ে দস্তুর মতো তর্কবিতর্ক এমন পর্যায়ে যেত যে, কোনো কোনো কর্মকর্তার জন্মের ইতিহাস, পরবর্তী বিবর্তন, সুবিধাবাদী মোড় ফেরা- সবই ‘উলঙ্গভাবে’ আলোচিত হতো। অন্তত আমাদের ’৭৯ ব্যাচের এবং পরবর্তী ’৮১ ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকে আলী-মনা আর বাজাদ-মনায় এমনভাবে চিহ্নিত হয়েছেন যে, পদোন্নতিতে তা প্রকাশ্যভাবে ধরা পড়ে গেল। এখন এমনও ধারণা করা হচ্ছে, ওই বিভাজনের সুফল ওই দুই গোষ্ঠী চাকরিতে থাকতে যেমন পেয়েছে, চাকরি-পরবর্তী পর্যায়েও পাবে। অনেকে এখনও পাচ্ছে। বাজাদ ক্ষমতায় এলে নাকি ’৭৯ ব্যাচের অনেক সাবেকের কপালে আবার শিকে ঝুলবে।
জোট-মহাজোটের নগ্ন দলীয়করণ সিভিল প্রশাসনকে যে রসাতলে নিয়ে গেল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খালেদা জিয়ার গত মেয়াদে আমাকেও আলী-মনা হিসেবে আমার ব্যাচমেটরাই প্রচার করেছে এবং আমার ব্যাচমেট কুশীলবরাই চার-চারবার আমাকে সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত করেছে, যার কিছুটা আমার ‘সরকারি চাকরিতে আমার অনুভূতি : পদোন্নতি, বঞ্চনা’ বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। নিজের ঢোল নিজে বাজানো নাকি উত্তম, অন্য কেউ বাজাতে গেলে তা আবার ফাটিয়ে ফেলতে পারে। আমি সরকারি চাকরিতে আমার অনুভূতি নিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত ৬টি বইয়ে যা লিখেছি, তাতে কোনো মনাগিরির স্থান আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। এমনকি ‘তত্ত্বাবধায়ক আমল : কিছু রাজনীতি কিছু বাজনীতি’ বইটিতে তত্ত্বাবধায়ক আমলের রাজনীতি-বাজনীতি নিয়ে, হাসিনা-খালেদার রাজনীতি নিয়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখাগুলোতেও আমি কোনো মনাগিরিতে ছিলাম না, যেমন আজও নেই। আমার কাছে যা যথাযথ মনে হয়েছে, যা সুবিবেচ্য ভেবেছি, যা জনগণের ধ্যান-ধারণা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি- তা-ই লিখেছি। আমি আগেও নয়, এখনও নয়, কোনো লাভের আসায় ‘পুঁজি-খাটানো’ অভ্যাসে কিছু লিখিনি, লিখি না। অতএব ১৫ জুনের চার সিটির নির্বাচন নিয়ে পূর্বাভাস সংক্রান্ত মতামতে বাজাদ-মনা হওয়ার যেমন কিছু নেই, তেমনি আমাকে আলী-মনা ভাবারও কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো লেখাকে বিশ্লেষণ করার অধিকার অবশ্যই পাঠকের রয়েছে। কিন্তু তেমন বিশ্লেষণ অবশ্যই নৈর্ব্যক্তিক হওয়া কাম্য। আর চার সিটির নির্বাচনের পূর্বাভাস নিয়ে আমি তো ফলাফলের আগে লিখেছি, পরে নয়; যেমনটি গাসিক নির্বাচনে ‘আনারসের হলে জয়, মজাটা কেমন হয়?’ লিখেছিলাম। ভোটের পরের বিশ্লেষণ তো গোটা দেশ করে চলেছে। সেই যে সিসিসি নির্বাচনে মহিউদ্দিনকে কুপোকাত করে যাত্রা শুরু হল, নারায়ণগঞ্জ আর কুমিল্লা হয়ে তা রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটে বিস্তৃত হল এবং আপাতত সর্বশেষ গাজীপুরে এসে সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে কী যেন একটা ‘জানান’ দিয়ে গেল, তা কি আর ধামাচাপা দেয়ার মধ্যে সীমিত থাকল? আলী-বাজাদ যার যার মতো নিজেদের পক্ষে গলাবাজি তো করেই যাচ্ছে, যাবেও, যেতেই হবে। এটা কখনও রাজনীতি, আবার কখনও বাজনীতি। তাই গাজীপুরের পর আমার কেন জানি আর লিখতে ইচ্ছা হয়নি। জাহাঙ্গীরকে নাটক করে দলীয় চাপে বসিয়ে না দিলে গাজীপুর হয়তো আরেক ‘নারায়ণগঞ্জ’ হতে পারত, যেমনটি বাজাদের জন্য ‘কুমিল্লা’ হয়েছে। প্রার্থী মনোনয়ন ও সমর্থনে আমরা যে ক্যারিকেচার দেখলাম, তাতে গণতন্ত্র তার উৎকট রূপই প্রকাশ করেছে। অতএব না লিখেই যেন আনন্দ পেলাম।
তার পর আরেক মজা হল, বিদেশ থেকে ফিরে এসে ‘তিনি’ নাকি কাদের ‘হারু পাট্টি’ বললেন! এরপর তো আরও ক্ষেপে গেলেন- উন্নয়ন করেও যদি ভোট না পাওয়া যায়, তাহলে আর উন্নয়ন করার দরকার কী? দিলে বড় কষ্ট পেয়েছেন তিনি- বোঝাই যায়। কিন্তু আমি বলব, উন্নয়ন করেছেন আগে ভোট পেয়েছেন বলে, উন্নয়ন করেছেন সরকার গঠন করতে পেরেছেন বলে, উন্নয়ন করেছেন মানুষের জন্য আপনার একটা ভালো দরদী মন আছে বলে। উন্নয়নের আগে তো আবার ভোট দিতে হবে তা বলেননি? রোজার পরে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে বিদ্যুৎ না থাকার কষ্ট বুঝিয়ে দেবেন বলেও ভয় দেখিয়েছেন তিনি। ক্ষমতায় যখন আছেন, তখন সবই পারবেন। নিষেধ করে কে? ফালতু কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাত্রদের ফুটেজ দেখে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন/বাদ দিয়ে দেবেন- কী প্রতিহিংসাপরায়ণ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ! এটা মানায় তাকে?
এই যে বারবার হেরে গিয়ে তার এত কষ্ট, তা আমাদেরও কষ্ট। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির এমনতরো সিরিজ-পরাজয় আমাদেরও বড় কষ্ট দেয়, দিয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও দেবে। কিন্তু বাস্তবতা তো আর উড়িয়ে দেয়া যায় না। আচ্ছা, তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, শেয়ার কেলেংকারিতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী কেমন কষ্ট পেয়েছেন? ডেসটিনি, হলমার্ক, যুবক নিয়ে ভুক্তভোগীরা কেমন কষ্ট পেয়েছেন? ড. ইউনূস ইস্যুতে অনেকে কেমন কষ্ট হজম করেছেন? ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি-খুনাখুনিতে, পদোন্নতির দলবাজিতে অন্যেরা কেমন কষ্ট পেয়েছেন? গাসিক নির্বাচনের আগ মুহূর্তে চট্টগ্রামের টেন্ডারবাজিতে খুন কি কাউকে কষ্ট দেয়নি? আমি কার খালুরে, মধ্যরাতের সিঁদেল চোর, মোটাতাজা ব্যক্তি কিংবা নির্বাচন করতে ব্যর্থ- এসব বলায় কি অন্যরা কষ্ট পাননি? কষ্ট মূলত যার যার তার তার, কে কাকে কখন কীভাবে কষ্ট দেয়, আর কে কখন কিসে কীভাবে কষ্ট পায় তা বুঝতে পারা বড় গুণ। এ গুণ না থাকলে অহমিকা থাকতে পারে, ঝাঁকুনিতে রানা প্লাজা ধসে যেতে পারে, টকশোতে কারও চোখ তুলে ফেলা যেতে পারে এবং আরও কত কী। কিন্তু মনের কষ্ট থামানো যায় না। ফলে ‘শত মণ দুগ্ধ নষ্ট বিন্দু গোচনায়’ হয়ে যায়, হয়ে যেতে পারে। তখন সে কষ্ট নিয়ে হা-পিত্যেশ না করে শোধরানোর চেষ্টাই উত্তম নয় কি? পাঁচ বছরে একবার, একটা সিল, কী ভয়ানক গণতন্ত্র! কেমনে যে এ দেশের মানুষ প্রতিবার পুরো পাঁচ বছরের হিসাব মনে রাখে এবং কোনটা যে তাদের মনকে স্থির করে দেয়, তা বারবারই আমাদের চমকিত করে। অতএব না লিখে চুপ থাকাই ভালো মনে হল, লিখতে আর ইচ্ছা হল না। তাই কষ্ট বুকে নিয়ে না লিখেই আনন্দ পেতে চাইলাম। ভাবলাম, ইটস বেটার নট টু হ্যাভ বর্ন দ্যান টু হ্যাভ বর্ন অ্যান্ড সাফার- জন্ম কষ্ট পাওয়ার চেয়ে না জন্মানোটাই উত্তম; অতএব এত উন্নয়নের পরও ‘শত মণ দুগ্ধ নষ্ট বিন্দু গোচনায়’ অবস্থায় গিয়ে কষ্ট করে, কষ্ট পুষে, কষ্ট ভরে লেখার চেয়ে না লেখাই বরং আনন্দের।
আরও কষ্ট যখন দেখি সাজেদা-হালিম সমর্থকদের সে কী লড়াই, হালিমের সে কী রক্তাক্ত ছবি, তারপর আবার হালিম-সমর্থকদের বাড়িঘর ভাংচুর! আহা, আবার দেখি আমাদের ‘ভাইছা’ ‘নতুনরূপে’ তোপখানা রোডে! সাংবাদিকরা হল হাত-পা মজবুত করার প্রশিক্ষণের এক বড় ‘বালির বস্তা’। পুলিশ সুযোগ পেলে থাপ্পড় মারবে, রাজনীতিকরাও ছাড়বে না। ব্যাটা সাংবাদিক, বোঝ না মনু, মুই কী! অ্যাডা কি মোগল সাম্রাজ্যের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম পেয়েছ নাকি? অ্যাডা হল গিয়ে দেশ কাঁপানো সাংবাদিক-লাত্থি মারা! আমি বিস্ময়ে হতবাক হই, তিনি না টকশোতে কত সুন্দর করে কথা বলেন! হবেই তো, সব গুণ থাকতে হয়, আইনের ছাত্রের ‘আÍরক্ষার’ কৌশল প্রয়োগ কি আর বেআইনি হতে পারে? সাংবাদিকরা বললেন, তাকে বয়কট করবেন। কিন্তু করলেন কই? এদিকে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোরগোল তুলে দিয়ে এক সাংবাদিক নেতা আবার কপালে রাজটিকা লাগালেন। তিনিও কী এক উপদেষ্টা হয়ে গেলেন, সংসদ নির্বাচনে হারলেও এবার তিনি আর হারলেন না। এই-ই যদি হয় অবস্থা, তাহলে না লেখাই কি উত্তম নয়? না লেখার মাঝেও যে আনন্দ আছে।
বড় কষ্ট লাগে যখন শুনি নব্বই ঊর্ধ্ব গো আযমের নব্বই বছরের জেল। কিন্তু বিচার যে, কিছু বলা যাবে না।
অপরাধ প্রমাণের পর তার আবার বয়স কিসের? অপকর্মের হোতা কি কারও বয়স বিবেচনা করেছিলেন? রহস্যটা কোথায়? তাকে জেলেও ঢুকতে হল না, অনুতপ্ত হতেও হল না, নিজের নীতিতে অটলই থাকলেন। অথচ ট্রাইব্যুনাল হলেন দয়ার সাগর। একবার মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে গেলে পরে দেখা যাবে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের গাড়ির বেঞ্চের তলায় কম্বল পেঁচিয়ে জেলে গিয়ে রক্ষা পেয়ে শাহ আজিজ যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তবে গো আযম নিরাশ হবেন কেন? হাসিনা-শফিক-হানিফের প্রতিক্রিয়া দেখে তো ‘নির্বুদ্ধিতায় ভরা’ আমজনতার মনে হতেই পারে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না’। আরও কত সন্দেহ- ‘সৌদি দয়া’, ‘নির্বাচনী-কূটচাল’, ‘বিচারটাই তো এখন হাতের পাঁচ’ ইত্যাদি ইত্যাদি!
সর্বশেষ আবার মনে পড়ল- ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’। ভাতের অভাব এখন নেই, কিন্তু ওয়াসার পানির আহা সে কী কষ্ট! এসি চালিয়ে তবে অজু করলাম একদিন। একটু ব্যবস্থা যাও হল, বস্তির নেতারা মধ্যরাতের সিঁদেল চোর না হয়েও আমাদের রাস্তায় পানি আসার চাবি বন্ধ করে দিল! বেচারা নির্বাহী প্রকৌশলী কত অসহায়। বস্তিতে যে অনেক ভোট, হোক না বিনে পয়সার পানি তাদের। লিখে বিপদে পড়ার চেয়ে, লিখে আলী-মনা আর বাজাদ-মনার অভিযোগে অহেতুক অভিযুক্ত হওয়ার চেয়ে না লেখার মাঝেও যে আনন্দ আছে, তা ভোগ করাই কি উত্তম নয়?
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.