প্রয়োজন একটি সামাজিক উল্লম্ফন by ড. শেখ জিনাত আলী

প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থায় বাঙালি সমাজ সেই কোন কালে গড়ে উঠেছে, তার হিসাব-নিকাশ কেউ করছে কি-না তা আমার জানা নেই। তবে এটা জানি, হাজার বছরে গড়ে ওঠা এ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে বংশপরম্পরায় যে কৌলিক উপাদান বাঙালির জীবন কাঠামোতে প্রবহমান, তা-ই বাঙালিত্বের শারীরিক-মানসিক সৌষ্ঠব এনে দিয়েছে। এ সমাজ ইতিমধ্যে তিনটি যুগ অতিক্রম করে এসে চতুর্থ যুগে পদার্পণ করেছে। সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগে, যাকে আমরা আদিম সাম্য, ভূমিদাসত্ব ও পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আর কলি যুগ আধুনিক সমাজবাদী বা সমাজতন্ত্রের তুল্য হতে পারে। বাংলাদেশে শতাধিক বছর কিংবা তার অল্পকাল পর কলির যুগ শুরু হয়েছে, যদিও চতুর্দশ শতাব্দীতে কলকারখানার উপাদান থেকে ইউরোপে পূর্বোক্ত যুগের অবসান হয়। প্রতিটি যুগ কিছু নিয়ামক দ্বারা সূচিত হয়েছে। আবার নিয়ামকগুলোর পরিসমাপ্তিতে মানুষ পরবর্তী যুগে প্রবেশের মধ্য দিয়ে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। মানুষ অগ্রসর হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে, আবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। গভীর বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, অদম্য মানুষ কোনো সমাজে বা দেশে অগ্রসর হতে চায় এবং কোথাও হচ্ছে। তবে অল্পসংখ্যক তাতে বাধা সৃষ্টি করছে। অগ্রসর হতে হলে অল্প সংখ্যকের এ বাধা অতিক্রম করতেই হয়। নইলে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
কলির যুগে আমরা ভারত উপমহাদেশের মানুষরা ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসন কবলে আটকা থেকেছি। ব্রিটিশ উপনিবেশে পলাশীর লব্ধ নিয়মনীতিতে আমরা শাসিত হয়েছি। ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ অটুট রাখার জন্য যা দরকার তার সবই করেছে। এই যা যা করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইচ্ছানুযায়ী ভারতীয়দের মধ্য থেকে একটি শাসক শ্রেণী সৃষ্টি করা হয় এবং ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তার হতে থাকে। কিছু দেশপ্রেমিক শিক্ষিত লোকজনও এর মাধ্যমে তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলও প্রতিষ্ঠিত হয় এসব শিক্ষিতজনের মধ্য থেকে এবং ভারতের সব জাতির জাতিসত্তার মধ্যেই তা কমবেশি বিস্তার লাভ করে। শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম। এতে নেতৃত্ব আসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫ থেকে), কমিউনিস্ট পার্টি (১৯২১ থেকে) ও কিছু আঞ্চলিক চরমপন্থী দল থেকে। মানুষকে ভালোবাসার, মানুষের জন্য কিছু মঙ্গলকর কর্ম সম্পাদনের এভাবেই শুরু হয়। অনুপ্রেরণা আসে ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব এবং বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ-শ্রমিক আন্দোলন থেকে। আমরা মে দিবসের কথা জানি। ইউরোপ, এশিয়ার বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষক-প্রজাদের আন্দোলন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। উল্লেখ্য, সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালে ঢাকায় গঠিত হলেও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে তার অবদান নেই বললেই চলে। বরং বলা চলে, তারা ব্রিটিশের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে উপনিবেশবাদ বিরোধী নবজাগরণ সৃষ্টি হলেও ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শিকার হয় এবং ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট গভীর রাতে পাকিস্তান নামের একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র মুসলমানদের উপহার দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী প্রয়াত লতিফ ভাইয়ের কথায় একে ‘জল্লাদের কাছে সোপর্দ’ বলা যায়। এটা হল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের রাষ্ট্র। এ রকম রাষ্ট্র পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এ রাষ্ট্রে ছিল একটি ভৌতিক কাণ্ড এবং ১৯৪৭-এর পর রাষ্ট্রটিতে অনুসৃত নীতিই ছিল বাঙালি জাতিসত্তার ওপর প্রথম আঘাত এবং এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলা অঞ্চলের বাঙালিকে জাতি হিসেবে বিকশিত হতে না দেয়া। তাই জাতিগত নিপীড়ন ও পূর্ববাংলার সম্পদ (পাট, চা, চামড়া ও মানুষ) লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়ন ছিল চোখে পড়ার মতো ঘটনা।
এভাবে নানা বৈষম্যের শিকার পূর্ব বাংলার মানুষকে পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম দাঁড়াতে হয়েছিল ১৯৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল, তার মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লীগের মোহভঙ্গ অংশ আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ছাত্র-যুব গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। এভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে, তারাই পরবর্তীকালে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ১৯৬৬-এর আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ১৯৬৯-এর ছাত্র সংগ্রামের ১১ দফা প্রণয়ন করে জনগণকে সংগঠিত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা নেয় এবং জেল-জুলুম, হত্যা, নির্যাতন ভোগ করে। এর ফলে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় আসে। কমরেড মণি সিংহকে কমপক্ষে ৪০ বছর আÍগোপনে থেকে এবং জেল থেকে সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হয়। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ন্যাপ গঠন করে প্রগতির পথে হাঁটতে থাকেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যদের সঙ্গে বন্দি হন। ১৯৬৮-তে সেনাবাহিনীতে কমিশনড র‌্যাংকে চাকরির জন্য ঢাকা সেনানিবাসে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা হল, আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমি ৬ দফা সমর্থন করি কি-না। আমার উত্তর ছিল হ্যাঁ সূচক। সে সময় আমরা যারা ওই সাক্ষাৎকার দিতে যাই, তাদের কারও চাকরি হয়নি। নতুন প্রজšে§র কাছে আমি কিছু কথা এখানে লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি, যাতে তারা পাকিস্তানি ২৩ বছরের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করে। কারণ এটা না বুঝলে বর্তমান দেশের সংকট-সমস্যা সম্পর্কে তারা অন্ধের হাতি দেখার মতো অবস্থায় থেকে যাবে। থেকে যাচ্ছে।
যে শিরোনামে লেখাটি শুরু করেছি, দেশের বর্তমান অবস্থা সঠিকভাবে বোঝার জন্য ওই প্রেক্ষাপট সবার কাছে খুবই গুরুত্ববহ হবে, আমি যা আগেই উল্লেখ করেছি। আজকের এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করতে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে এক নদী রক্ত ঝরাতে হয় বাঙালিকে। পশ্চিমা শাসকদের সীমাহীন শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাতে লাখো প্রাণের রক্তের ঋণ শোধ হতে পারে শুধু শোষণহীন সোনার বাংলা (বঙ্গবন্ধুর ভাষায়) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর তা করতে হলে আমরা যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে যুদ্ধ করেছি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীনের পাকিস্তান প্রীতি উপেক্ষা করে, তার বাস্তবায়ন ছাড়া এখানে সেখানে কিছু চুনকাম করে কিছুই করা যাবে না। আমাদের ১৯৭২-এর সংবিধান সে জন্য সর্বাগ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি। এটা করতে যত কালক্ষেপণ হবে, তত দেশে বিশৃংখলা বাড়বে।
আজকের প্রজš§ ভীষণভাবে হতাশ দেশের বর্তমান সৃষ্ট সংকট-সমস্যায়। সময় এসেছে ২০০৮-এর নির্বাচনে মহাজোট সরকারের অগ্রাধিকারগুলোর দিকে যথাসম্ভব দৃষ্টি দেয়ার, যেমন (ক) ১৯৭২-এর সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ পুনরুজ্জীবন, (খ) যুদ্বাপরাধীদের বিচারের যে রায় ইতিমধ্যে হয়েছে, তা দ্রুত কার্যকর করা, (গ) নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা, (ঘ) বিদ্যুৎ, গ্যাস, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, (ঙ) দুর্নীতি নির্মূলসহ আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন ও বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এবং (চ) গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার তথা সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাজের পরিধি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সংসদ সদস্যদের কর্মক্ষেত্র আলাদা করে সমন্বয় সাধন করা এবং সংসদ সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে øাতক ডিগ্রি করা।
এ কাজগুলো করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দক্ষ কর্মশক্তি ও ব্যক্তি সৃষ্টি করার বিকল্প নেই এবং এরূপ লোকজনকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করতে হবে, যাতে দেশে একটি আর্থ-সামাজিক উল্লম্ফন ঘটানো যায়। দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারলে সমাজে ও প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। কৃষি-শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রাম সমবায় ও শ্রমিকের অংশীদারিত্বমূলক শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। এতে মানুষের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে হলে মানুষের সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে দেশে কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, থাকতে দেয়া যায় না। কথাটি মনে রাখার জন্য গণমাধ্যমের আলোচনায় অংশ নেয়া বক্তাদের বিনীত অনুরোধ করছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া সামাজিক উল্লম্ফন ঘটানো যাবে না এবং সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন হবে না।
ড. শেখ জিনাত আলী : অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.