ডিসিসির নির্বাচন নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরাদ্বিধাদ্বন্দ্বে by আনোয়ার হোসেন

একদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি, অন্যদিকে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা—এই দ্বৈত অবস্থান দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলেছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের।ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত নথি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ কমিশনের বৈঠকে তা উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শিগগিরই হচ্ছে—এ বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারছেন না সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীরা। গত বছরের ৯ এপ্রিল ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। গত বছরের ২৪ মে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে সময় প্রায় দুই ডজন প্রার্থী মেয়র পদে এবং কয়েক শ কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। তফসিল ঘোষণার আগেই পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল শহর। কিন্তু এবার সে রকম চোখে পড়ছে না। সীমানা নির্ধারণসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনের কয়েকটি ধারা মানা হয়নি—এই অভিযোগে হাইকোর্টে রিট করা হলে নির্বাচন স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ১৩ মে এই রিট (রুল ডিসচার্জ) খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ২০১০ সালেও একবার ডিসিসি নির্বাচন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সীমানাবিন্যাসের দাবি জানিয়ে একাধিক রিট হওয়ায় তা ভেস্তে যায়। এরপর কয়েক দফা চেষ্টা করেও সরকারের অনীহার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। এবার নির্বাচন কমিশন আবার সিটি নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে। আদালতের দিক থেকেও কোনো সমস্যা আপাতত নেই। কিন্তু এখনো আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার চেয়ে অপেক্ষায় থাকার পক্ষে বেশির ভাগ প্রার্থী। মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী অনেক প্রার্থী বলেছেন, ঢাকায় আগামী এক মাস সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রার্থীদের আরও দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। তাই তফসিল ঘোষণার আগে প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণায় নামতে চাইছেন না কেউ। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জানিয়েছেন, প্রকাশ্যে না হলেও তাঁরা ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, রমজান মাসের আগে নির্বাচন করতে হলে দু-চার দিনের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) কমিশনের বৈঠক হবে।
তবে রমজানের আগে ডিসিসি নির্বাচন করার পক্ষে নন কমিশনার আবদুল মোবারক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রমজানের পরে নির্বাচন হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে। আগে করা হলে মামলা-মোকদ্দমা হয়ে যেতে পারে।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নকে দক্ষিণ সিটির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এই ওয়ার্ডের সীমানা বিন্যাস করা হয়নি। এ বিষয়ে গত সপ্তাহের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড এখনো দক্ষিণ সিটির আওতাভুক্ত হয়নি। তাই এই ওয়ার্ডকে বাদ রেখে নির্বাচন করা যেতে পারে।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, গতকাল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের তালিকা ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেলও চূড়ান্ত হয়েছে।
 আইনি ও পরিস্থিতিগত অবস্থার বাইরে এই নির্বাচনের রাজনৈতিক রসায়নও গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, বিরোধী দল যাতে নির্বাচনকালীন সরকারের ইস্যুতে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, সে জন্যই ডিসিসির নির্বাচন দিতে চাইছে সরকার। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের ইস্যু বাদ দিয়ে মানুষ ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে মেতে থাকবে—এমনটা মনে করছে না বিএনপি। এর পরও তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে বিএনপি একেবারে ছেড়ে দেবে না, একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
আর আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে কিংবা দলীয়ভাবে মেয়র পদে একক প্রার্থী দেওয়ার উদ্যোগ নেবে। আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে কাউকে সমর্থন না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হবে। তবে সরকার বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে দলের অবস্থা জরিপ করাচ্ছে।
গত বছর স্থগিত হওয়া নির্বাচনে ডিসিসি উত্তরের জন্য মনোনয়নপত্র কেনা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, চার বছর নির্বাচন হয়নি। সরকারের শেষ সময়ে এসে সংঘাত, আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতার মুখে ডিসিসি নির্বাচন করার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটা খোলাসা হওয়া দরকার। সরকারেরই দায়িত্ব এটা খোলাসা করা। কিন্তু তারা তা না করে এর মধ্যে ঢাকায় সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর জন্য ২৫ মে মিরপুরে একটি মতবিনিময় সভা করার কথা থাকলেও তিনি সংশয়ে আছেন করতে পারবেন কি না। তিনি বলেন, ‘সবকিছু খোলাসা হলে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নাগরিক ঐক্যের প্রার্থী হিসেবে আমি নির্বাচন করব।’
মেয়র পদে নির্বাচনে ইচ্ছুক সরকারি দলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন করতে চাইলে সরকার ক্ষমতায় এসেই করত। এখন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকারের জনপ্রিয়তার পড়তির সময় নির্বাচন দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠছে।
উত্তরে কারা প্রার্থী
স্থগিত হওয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ও স্বতন্ত্র যেসব নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন, এখনো পর্যন্ত আলোচনায় তাঁরাই আছেন। নতুন করে কারও নাম শোনা যাচ্ছে না। দুই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাই মনে করছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অরাজনৈতিক হলেও তফসিল ঘোষণা হলে দল একজনকে সমর্থন দেবে।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন গত বছর। এবারও সরকারি দলের পক্ষে ডিসিসি উত্তরে তিনি জোরালো প্রার্থী। সেখানে ১৪ দলের শরিক জাসদের শিরিন আখতারও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন স্থগিত নির্বাচনে।
স্থগিত নির্বাচনে উত্তরে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নাম এসেছিল ব্যবসায়ী ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর। তবে সিটি করপোরেশন দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় তিনি প্রার্থী হতে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তবে দলের প্রধান চাইলে তিনি প্রার্থী হতে রাজি ছিলেন বলে তখন শোনা যাচ্ছিল। এখনো সেই অবস্থানেই আছেন তিনি। মিন্টু প্রার্থী না হলে কে প্রার্থী হবেন, তা নিয়ে নানা প্রচার আছে। আপাতত তিনজনের নাম আছে এই আলোচনায়।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থীর আগ্রহ রয়েছে। স্থগিত হওয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র মো. হানিফের ছেলে সাইদ খোকন ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামানও তখন মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন বলে জানা গেছে। এবারও তাঁর আগ্রহ আছে। নির্বাচনে আগ্রহ আছে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালামেরও।স্থগিত হওয়া নির্বাচনে ডিসিসি দক্ষিণে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ এবং নির্দলীয় হিসেবে তুহিন মালিক তৎপর ছিলেন।
কে কী বলেন
 জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আগে তফসিল হোক, তারপর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।’ নির্বাচন করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই প্রস্তুত। নির্বাচন হলে প্রার্থী হব।’জাসদের নেত্রী শিরিন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নির্বাচনের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত। কিন্তু সরকার তো এক মাসের জন্য সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে রোজার আগে নির্বাচন কীভাবে হবে? পরে হলে কখন হবে, এটা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি তো প্রথম থেকেই কাজ করছি। এর আগে দল আমাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দিয়েছিল। এবার নির্বাচন হলে দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করব।’
দক্ষিণের প্রার্থী হতে আগ্রহী ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, বিএনপির মূল দাবি দুই সিটি করপোরেশনকে এক করা এবং ক্ষমতায় গেলে সেটাই তারা করবে। তবে সরকার বিভক্ত সিটি করপোরেশনে নির্বাচন দিয়ে দিলে তারা নির্বাচন ছেড়ে দেবে না। নিজের ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা আমাকে মেয়র পদে দেখতে চান। আমিও প্রস্তুতি নিয়ে আছি। নির্বাচন হলে দাঁড়াব। তফসিল ঘোষণার পর পার্টি ঠিক করবে বাকিটা।’দক্ষিণের সম্ভাব্য প্রার্থী সাইদ খোকন বলেন, অনেক দিন ধরেই তিনি ডিসিসি নির্বাচনের জন্য কাজ করছেন। নির্বাচন হলে তিনি প্রার্থী হবেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ডিসিসি নির্বাচন হবে—এটা সিদ্ধান্ত। এখন কবে হবে সেটা ঘোষণার বিষয়। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর মেয়র পদে একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান বলেন, ‘সরকার ডিসিসি নির্বাচনকে বিরোধী দলকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখার কৌশল মনে করতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি, এই নির্বাচনও আন্দোলনের একটি অংশ। নির্বাচনে দলের অনেকেই নাগরিক ফোরামের হয়ে প্রার্থী হবেন। তাঁদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.