উদ্ধার অভিযান শেষের পথে, দিশেহারা স্বজনেরা

সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। আজ সোমবার উদ্ধারকাজ শেষ হয়ে যেতে পারে বলে উদ্ধারকারীদের পক্ষ থেকে আভাস দেওয়া হয়েছে। এরপর সেনাবাহিনীর কাছ থেকে রানা প্লাজার দায়দায়িত্ব ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অভিযান শেষ হতে চললেও স্বজনহারাদের কান্না থামছে না। গতকালও অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে শ দুয়েক স্বজনহারা ব্যক্তিকে প্রিয়জনের লাশের জন্য ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। অনেকেই স্বজনের লাশের হদিস না পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বেড়িয়েছেন। কয়েকজন স্বজনহারা ব্যক্তি বলেছেন, উদ্ধার অভিযান শেষ করে সবাই বাড়ি চলে যাবে। আমরা কী নিয়ে বাড়ি যাব। লাশটা পেলে তো সান্ত্বনা পেতাম। গত শনিবার রাত ১১টা থেকে গতকাল রোববার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চারটি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার অভিযান শুরুর পর থেকে গতকালই সবচেয়ে কম মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই নিয়ে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২৭ জনে। ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন নিচতলার মেঝে সরানোর কাজ চলছে। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, নিচতলার মেঝেটা খুব পুরো ও শক্ত। এর নিচেই গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান। সেখানে প্রচুর পানি জমে ছিল। গতকাল দিনভর সে পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে। কয়েকটি স্থানে নিচতলার মেঝে কেটে পার্কিং এলাকার ধ্বংসস্তূপ সরানো হয়েছে। এ সময় ভবনের পেছনের দিকে পার্কিংয়ে থাকা কয়েকটি কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু টেবিল-চেয়ার, ক্যাবিনেট এবং দেয়ালের কিছু অংশ অক্ষতই দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ভবনের অন্যতম মালিক সোহেল রানার অফিস-কক্ষ। ভবনটির বেজমেন্টে সোহেল রানার ব্যক্তিগত কার্যালয় ছিল। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, শনিবার দিবাগত রাত ১২টার পর দীর্ঘক্ষণ কোনো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। রাত তিনটা ২৫ মিনিটে একজন পুরুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওই মৃতদেহের সঙ্গে একটি পরিচয়পত্র ছিল, যার নম্বর ১২ হাজার ৫১। নাম পিন্টু, ধসে পড়া ভবনের তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। মৃতদেহের সঙ্গে একটি মুঠোফোন পাওয়া যায়। কিন্তু উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ফোনের সিমকার্ডটি অকেজো হওয়ায় তা থেকে সেভ করা নম্বর বের করে স্বজনদের খোঁজ করা যায়নি। সাধারণত মুঠোফোন পাওয়া গেলে সিমটা চালু করে সেভ করা নম্বরে ফোন করে স্বজনদের খুঁজে বের করা হয় এবং পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। এরপর সকাল নয়টার দিকে একটি মাথার খুলি পাওয়া যায়। বেলা ১১টার দিকে একজন পুরুষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মৃতদেহের সঙ্গে কোনো পরিচয়পত্র কিংবা মুঠোফোন পাওয়া যায়নি। ফলে পরিচয় অজানা লিখে অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, পরিচয় পাওয়া গেলে এবং স্বজনদের সন্ধান পেলে মৃতদেহের সঙ্গে এসব তথ্য অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর পরিচয় না পেলে লাশবাহী পলিথিনের প্যাকেটে মার্কার দিয়ে শুধু মাথার দিকটা চিহ্নিত করে ‘অজানা’ লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আজমল কবীর গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, এখন কারও জীবিত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। উদ্ধারকর্মীরা এখন বেজমেন্টের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন। পার্কিংয়ে কিছু গাড়ি দেখা গেছে। তবে সেখানে পানি জমে রয়েছে। পানিনিষ্কাশন আর বেজমেন্টের ছাদ পুরোটা সরানোর কাজ চলছে। পার্কিংয়ে কোনো মৃতদেহ রয়েছ কি না, তা খুঁজে দেখার পর অভিযান শেষ করা হবে। আজ সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ অভিযান শেষ করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ভবনধসের ঘটনায় এক হাজার ১১৫টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। তবে এর মধ্যে ১২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ১২৭। স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৮৩২টি মৃতদেহ। হস্তান্তরের অপেক্ষায় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ ও বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে রয়েছে ৬১টি মৃতদেহ। আর জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাম-পরিচয়হীন ২৩৪টি মৃতদেহ। স্বজনেরা এখনো অপেক্ষায়: গতকাল দুপুরে বগুড়ার সোনাতলার আরশেদা বেগম ও তাঁর ছেলের বউ কোহিনূর জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করছিলেন অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। বিলাপের সুরে আরশেদা বলছিলেন, ‘আমার ছেলেরে আল্লাহ পছন্দ করে নিয়ে গেছে। লাশটা দিলে আল্লাহর কী ক্ষতি হবে। আল্লাহ তুমি লাশটা দাও।’ আরশেদার ছেলে আসাদুল ব্যাপারী রানা প্লাজার সপ্তম তলায় কাজ করতেন। কোহিনূর বলেন, ‘চার বছর আগে আমার বিয়ে হয়। একটা ছেলে হয়েছিল। সে-ও মারা গেছে। এখন আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই।’ সাভার ব্যাংক কলোনির ফজল ব্যাপারী ও ববিতার ছেলে মনির হোসেনের এখনো সন্ধান পাননি স্বজনেরা। ববিতা বলেন, ‘সবাই বলছে ঢাকায় গিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করতে। ঢাকা গেলে এর ফাঁকে যদি আমার মনিরের লাশ অধরচন্দ্রের মাঠে চলে আসে তাহলে তো অন্যরা নিয়ে যেতে পারে। তাই যাচ্ছি না।’ ফজল ব্যাপারী বলেন, ‘শুনেছি উদ্ধারকাজ শেষ হয়ে যাবে। সবাই বাড়িতে চলে যাবে। আমি কী নিয়ে বাড়ি যাব। আমি তো আমার মনিরের লাশ এখনো পাইনি।’ গতকাল অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নওগাঁর প্রভাত চন্দ্র বসু ও বিলকিস আক্তারের স্বজনেরা এই প্রতিবেদককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অভিযান শেষ হয়ে গেলেও যদি স্বজনের লাশ পাওয়া না যায়, তাহলে কী হবে এই ভেবে অনেকে দিশেহারা বোধ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.