মোবাইলে বন্দি সেই টর্নেডো by জাবেদ রহিম বিজন

ভয়াবহ সেই টর্নেডো বন্দি মোবাইলে! ঘুরছে হাতে হাতে। মোবাইলের ভিডিওতে ধারণ করা ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তটি সংগ্রহে রাখতেই মানুষ ছুটছে বিভিন্ন মোবাইলের দোকানে। ১০-২০ টাকায় ডাউন লোড করে নিচ্ছে দুর্লভ ওই  ভিডিও ক্লিপটি।
স্থানীয় কেবল অপারেটররা ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেটি প্রচার করছে তাদের ডিশ চ্যানেলে। টর্নেডো ধেয়ে আসার সেই মুহূর্তটি যিনিই দেখছেন তিনিই আঁতকে উঠছেন। ঘটনার পর সংবাদ সংগ্রহ করতে ঢাকা থেকে আসা বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার সাংবাদিকরাও এটি সংগ্রহ করে তাদের সম্প্রচারে ব্যবহার করেছেন। টর্নেডোর আঘাত হানার ওই রাত থেকে এটি ছড়াতে থাকে ব্লু টুথের মাধ্যমে মোবাইলে মোবাইলে। ভিডিও ক্লিপটিতে দেখা গেছে কিভাবে ধেয়ে আসছে টর্নেডো নামের সেই দানব। রাস্তা ধরে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে মানুষ। প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দও ভেসে আসছিল তখন। যে যেদিকে পারে ছুটছে আতঙ্কে। এমনি সময়ে হাতে থাকা মোবাইলের ভিডিওতে সাহস করে কেউ কেউ ধারণ করেন এই টর্নেডো। তাদের একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়ার আবু শাহাদত মো. নাঈম। তিনি জানান, ওইদিন বিকালে মোটরসাইকেলে করে তার বন্ধু বাবুর শ্বশুরবাড়ি বাসুদেব গ্রামে যাচ্ছিলেন। উড়শীউড়া থেকে জেলা কারগারের উত্তর পাশ দিয়ে ফুলবাড়িয়ার রাস্তা ধরে তারা এগোচ্ছিলেন। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল বাবু। নাঈম জানান কিছুদূর এগিয়ে একটি মাদরাসার কাছে পৌঁছার পর কয়েকটি ছেলে এসে আমাদেরকে বলে আপনাদের পেছনে আগুন লাগছে কিসের। আমরাও পেছন ফিরে পশ্চিম দিকে চেয়ে দেখি ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠছে। আমরা তখন কোথাও আগুন লেগেছে ভেবে এগোতে থাকি। আবার মনে করেছিলাম গ্যাসের আগুন। এরই মধ্যে হঠাৎ করে শরীরের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস লাগে। কিন্তু বাসুদেব রেললাইনের কাছে যাওয়ার পর আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারি কালো ধোঁয়াটি আসলে টর্নেডো। সেখানে মসজিদের সামনে একটি বাচ্চার লাশ পড়ে থাকতে দেখি। অনেক বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। তার আগে চিনাইর বাজারে আমরা মোটরসাইকেলটি এক জায়গায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকি। শুরু থেকে আমরা এই অবস্থার মধ্যে যখন এগোচ্ছিলাম তখনই দেখি গ্রামের নারী-পুরুষকে দৌড়ে পালাতে। কার আগে কে দৌড়াবে এমন অবস্থা। আমরা এর মধ্যেই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। নাঈম আরও জানান, উড়শীউড়া থেকে ফুলবাড়িয়া পেরিয়ে রেললাইনের কাছে কালো ধোঁয়ার চক্করটি একটি মোড় নিয়ে চান্দপুর-চিনাইরের দিকে এগোয়। সেখান থেকে মোড় নিয়ে তা আবার চিনাইর কলেজের সামনে থেকে আরেকটি মোড় নিয়ে রাস্তা ধরে বাসুদেব ও চান্দির দিকে এগোতে থাকে। ১৫-২০ মিনিট ধরে তারা এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। নাঈম ৩ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড এবং তার বন্ধু বাবু প্রায় ৫ মিনিট টর্নেডোর মুহূর্তটি তাদের মোবাইলের ভিডিওতে ধারণ করেন। একটি টিভির ভিডিওগ্রাফিতে জড়িত আকবর হোসেন চুন্নু জানান, ঘটনার পরদিন সকালে তারা উড়শীউড়া যাওয়ার পর অনেকেই এসে বলে তাদের মোবাইলে টর্নেডোর দৃশ্যটি ধারণ করা আছে। ফুলবাড়িয়া গ্রামের একটি ছেলের মোবাইলে আমি এটি প্রথমে দেখি। কিন্তু আমার মোবাইলটিতে ব্লুটুথ না থাকায় ভিডিও ক্লিপটি তখন আনতে পারিনি। পরে তার কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করি। এরপর আমরা স্থানীয় ডিশ চ্যানেলে এটি প্রচারের জন্য দিই। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে এর প্রচার চলতে থাকে। এর পাশাপাশি স্ক্রলে আমরা টর্নেডো দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রাখি। টর্নেডোর এই ভিডিও ক্লিপটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর সম্প্রচার বন্ধ রাখলে লোকজন ফোন করে। অনুরোধ করে তা চালানোর জন্য। বলে এখন নাটক-সিনেমা দেখানোর সময় না। টর্নেডো এবং পরের অবস্থার ক্লিপটি দেখে লোকজন অবস্থা অনুধাবন করে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছুটে যায়। চুন্নু জানান, এই ভিডিও ক্লিপটির চাহিদাও বেড়ে গেছে মানুষের কাছে। এটি শহরের বিভিন্ন মোবাইলের দোকানে ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ২২শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার ১৫টি গ্রামে আঘাত হানে ভয়াবহ এই টর্নেডো। এতে ৩২ জন নিহত ও ৫ শতাধিক লোক আহত হন। গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুনের গোলার আকৃতিতে এই টর্নেডো একের পর এক গ্রামে আঘাত হেনে যখন এগোচ্ছিল তখন বিকট শব্দ হচ্ছিল। অনেকটা যুদ্ধ বিমানের শব্দের সঙ্গেই এর তুলনা করেন তারা। আর এর চারপাশ পাতা উড়তে থাকে। পরে মানুষজন বুঝতে পারেন সবকিছু গ্রাস করে এগিয়ে চলা টর্নেডোর বৃত্তের বাইরে যেগুলো তারা পাতার মতো উড়তে দেখেছেন সেগুলো আসলে বাড়িঘরের টিন আর বিভিন্ন জিনিসপত্র।
মারা গেছেন আরেক বৃদ্ধা: ৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহম চান (৬৫) মারা গেছেন সোমবার সন্ধ্যায়। তার বাড়ি জারুলতলা গ্রামে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২-এ। টর্নেডোতে আহত আরও অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
বিজিএফসিএল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন: টর্নেডো দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) অফিসার ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। তারা এক জরুরি সভা করে টর্নেডোতে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ওই সভায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনপূর্বক কোম্পানির ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভিত্তিক কর্মকর্তারা তাদের বার্ষিক বনভোজন এবং খেলাধুলা-২০১৩ বাতিল করে। এজন্য বরাদ্দ করা অর্থ এবং একই সঙ্গে সকল কর্মকর্তাদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ  টাকা মিলিয়ে মোট ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মঙ্গলবার থেকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এই অর্থ বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে। এ সময় কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারগণ এবং ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.