আল জাজিরার রিপোর্টঃ যুদ্ধাপরাধের বিচার পুরনো ক্ষতকে জাগিয়ে তুলেছে

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার পুরনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এত বিপুল পরিমাণ মানুষ নিহত ও নির্যাতনের শিকার হওয়ায় সারা বাংলাদেশে এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
এ বিচারে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পুরো শীর্ষ নেতৃত্বই কাঠগড়ায়। জামায়াত নিজেও নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে জামায়াতের দু’জন এমপি থাকলেও অনেক বাংলাদেশী দাবি করছেন জামায়াত ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে। কিন্তু জামায়াতের সমর্থকরা লড়াই ছাড়া তা মেনে না নিতে বদ্ধপরিকর। তারা যে তা করবে তা গত কয়েক সপ্তাহের সহিংসতায় দেখা গিয়েছে। অনেক নাগরিক মনে করেন, আধুনিক উদার মূল্যবোধের বাঙালি হিসেবে আবির্ভূত হতে বাংলাদেশকে কিছু ঝুঁকি মোকাবিলা করতেই হবে। তারা মনে করেন, বর্তমানে যে লড়াই চলছে তা অপরিহার্য। এসব কথা বলা হয়েছে অনলাইন আল জাজিরার এক রিপোর্টে। ২৬শে মার্চ প্রকাশিত ‘ইনফোগ্রাফিক: টারময়েল ওভার বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনাল’ শীর্ষক গ্রাফিক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়। এতে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটি কালপঞ্জি দেয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার গণহত্যার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ পর্যায়ের কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিচারে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। কিন্তু এর বিরোধিতা করছে বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তারা বলছে, এ বিচার করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে। কেন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আদালত গঠন করা হয়েছে তা নিয়ে একটি সেকশনে বলা হয়েছে, সরকারের দাবি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল তাদের বিচার করার জন্যই গঠন করা হয়েছে এ আদালত। সরকারি হিসাবে বলা হয়, প্রায় ৯ মাসের ওই যুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও এদেশে তাদের দোসরদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়েছেন কমপক্ষে আড়াই লাখ নারী। ওই সব গণহত্যা ও গণধর্ষণের বিচারের জন্য জনতার তীব্র চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। এতে বলা হয়, আফ্রিকার দেশ দারফুরের যুদ্ধে ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। রুয়ান্ডাতে গণহত্যায় নিহত হয়েছেন ১০ লাখ মানুষ। কম্বোডিয়ায় গণহত্যার শিকার হয়েছেন ২০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হলোকাস্টের সময় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ১৯৭৩ সালে এ বিচারের জন্য পাস করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন (আইসিটিএ)। কিন্তু ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর যেসব সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি। ১৯৯০-এর দশকে যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় তখন এ অপরাধের যথার্থ বিচার চেয়ে মাঠে নামে একাত্তরের ঘাতক ও দালাল নির্মূল কমিটি নামের একটি সংগঠন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে দিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। ভূমিধস বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে প্রথম গঠন করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। দ্রুত বিচারের জন্য ২০১২ সালে গঠন করা হয় দ্বিতীয় আদালত। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মোট ৩৪৫টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের রয়েছে ২৩০টি। এর ফলে পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর পরে যে দু’টি দল রয়েছে তারা হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টি। যথাক্রমে তাদের আসন ৩০টি ও ২৭টি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী। তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতায় সমর্থন দিয়েছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। তাদের নেতাকর্মীরা পাকিস্তানের সেনাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে- যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু, অবাধ ও স্বচ্ছভাবে চলছে। তাদের দাবি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের মানদণ্ড অনুযায়ী চলমান বিচার প্রক্রিয়া অভিযুক্তদের আত্মীয়স্বজন, সাংবাদিক ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু বিরোধীরা বলছেন এই আদালত সরকারের অনুগত। এক্ষেত্রে তারা স্কাইপ সংলাপ ও বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বিরোধী দল আরও অভিযোগ করেছে, বিচারকরা প্রসিকিউশনের সঙ্গে হাতে হাত বাঁধা। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের অভাব ও অভিযুক্তদের যেভাবে নেয়া হয়েছে সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ওদিকে জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক দাবি করেছেন জামায়াত একীভূত পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু তারা কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। তার দাবি আদালতের এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত ৪০ বছরে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও গঠন করা হয় নি। তিনি আরও বলেন, ১৯৮০ সালে এখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন এখন যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করা হচ্ছে তারা। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ মোকাবিলা করছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা ও মতিউর রহমান নিজামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাক এই বিচার নিয়ে মানবাধিকার গ্রুপগুলোর সমালোচনার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তারা এই বিচারকে ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। এর পরে ওই রিপোর্টে জামায়াতের তিন নেতার রায় ঘোষণা ও তারপর সৃষ্ট সহিংসতার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, জামায়াত সমর্থক ও শিবির সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে বেশ কতগুলো মন্দির, বাড়িঘর। শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এতে।

No comments

Powered by Blogger.