২২ দিনের ব্ল্যাকআউটে বাংলাদেশ

হরতাল-ছুটি মিলে মার্চে ২২ দিনের ব্ল্যাকআউটে বাংলাদেশ। পাঁচ দফায় বিরোধী দল হরতাল পালন করে ৯ দিন। ব্যতিক্রম হিসেবে এ মাসে শুক্র ও শনিবার ছিল ১০ দিন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ছুটি ছিল আরও দুই দিন, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে অনির্ধারিত রাষ্ট্রীয় ছুটি হয়েছে আকস্মিকভাবে আরও একদিন।
সব মিলিয়ে ২২ দিন বন্ধ ছিল অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। বন্ধ ও ছুটিতে কারখানার উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল স্থবির। গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পোহাতে হয়েছে অপূরণীয় ধকল। শিক্ষা কার্যক্রম বিধ্বস্ত। পরীক্ষার তারিখ বদলাতে হয়েছে বারবার। নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ছে। হরতাল ও টানা বন্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, হকারসহ খেটে খাওয়া মানুষদের।  তাদের মাথায় হাত। এই এক মাসের বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটাতে অনেকের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম। অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছেন অর্থমন্ত্রীও। ছুটি হরতালের ধকল কাটাতে আমদানি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শুক্র ও শনিবার খোলা রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
পরিস্থিতিতে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হরতাল বন্ধের আহ্বান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সোমবার বলেছেন, বিগত যে কোন বছরের তুলনায় অর্থনীতি ভাল হলেও একটা বিপর্যয় (সেটব্যাক) হতে পরে। ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই-এর হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৭-৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯৬০ দিনের বেশি হরতাল হয়েছে, যা প্রায় তিন বছরের কাছাকাছি। সাবেক সভাপতি আনিসুল হক মানবজমিনকে বলেছেন, অর্থনীতিবিদরা যে ডাটা তুলে ধরেন তাতে হরতালের কারণে দিনে এক হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়। ঢাকা  চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই)-এর সভাপতি আবদুস সবুর খান সম্প্রতি এক বক্তব্যে একদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি ডলার বা ১৬০০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন। ১৫ দিনের হরতালে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তা দিয়ে অনায়াসে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব বলে ব্যবসায়ীদের একটি গবেষণার বরাতে তিনি মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাহিদা কমে যাচ্ছে। শিল্প ও সেবাখাতের খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এর আগে ২০০৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা  (ইউএনডিপি)-র এক গবেষণায় এক দিনের হরতালে বাংলাদেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৫৪ কোটি টাকা। ইউএনডিপির ওই গবেষণার সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল ৪ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। তারপর আট বছর পেরিয়েছে। ৮ বছরে অর্থনীতির আকার দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বেড়েছে হরতালে নাশকতার মাত্রা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হরতালে অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণও। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ওয়াল-মার্টের মতো আরও বেশ কিছু বড় বড় তৈরী পোশাকের ক্রেতা বাংলাদেশ  থেকে সরে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে টেসকো, ভিএফ করপোরেশন প্রভৃতি। শুধু গত ৪ মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০  কোটি ডলারের কাজ প্রত্যাহার করে ভারতে নিয়ে গেছে ক্রেতারা। হংকংয়ে ফরাসি চেম্বার অব কমার্সের বৈঠকে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বলেও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়।
মৃত্যু আতঙ্ক: দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর মার্চ মাসের ৩রা ও ৪ঠা মার্চ হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামী। হরতালের আগেই অচল হয়ে পড়ে সব কিছু। সংঘাতের চিত্র ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী সারাদেশের এতে নিহতের সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে ৬ পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ১৪৫ জনের মৃত্যুর কথা। রেললাইন, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি থেকে শুরু করে এমপির বাড়িও রক্ষা পায়নি হরতালের সহিংসতা থেকে। এই মৃত্যুর ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ উল্লেখ করে প্রতিবাদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া হরতাল ডাকেন আরও ১২ ঘণ্টা। ৬ই মার্চ বিএনপির মিছিলে পুলিশের গুলি ও বাধার প্রতিবাদে আবারও ৭ই মার্চ হরতাল আহ্বান করা হয়। ১১ই মার্চ বিএনপির অফিসে পুলিশি হামলার ও অভিযানের প্রতিবাদে আবারও হরতাল ডাকে ১২ই মার্চ। এরপর ১৮ ও ১৯শে মার্চ আবারও ৩৬ ঘণ্টার হরতাল ডাকে তারা। এতে রাজধানীতেই অন্তত ২৩টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশের গুলি ও দু’পক্ষের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় আরও দু’জনের। সবশেষে আবারও ২৭ ও ২৮শে মার্চ ৩৬ ঘণ্টার হরতাল ডাকে বিএনপি। এছাড়া ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে একদিন এবং বিভিন্ন দাবিতে সিলেট, মেহেরপুর, যশোরের মনিরাপপুর, চট্টগ্রামেসহ বিভিন্ন জেলায় আঞ্চলিকভাবে হরতাল ডাকা হয়।
পরিবহন খাতে লাল বাতি: এসব হরতালের সহিংসতায় লাল বাতি জ্বলার উপক্রম হয়েছে দেশের পরিবহন খাতে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, মার্চ মাসের প্রথম ১৮ দিনে অন্তত ১২৪টি যানবাহন পোড়ানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে যানবাহন পোড়ানোর ঘটনায় গত পাঁচ মাসে ক্ষতি হয়েছে ১৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। মার্চ মাসের প্রথম চারদিনের সহিংসতায় পরিবহন খাতে ১৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে বাস-ট্রাক মালিক সমিতি ও বিআরটিএ জানিয়েছে। রেললাইন ও স্টেশনে আগুনের ফলে চলতি মাসের প্রথম ১৪ দিনে বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষতি হয় নয় কোটি ৩৯ লাখ টাকার। এছাড়া ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি ও মুনাফার ঘাটতির পরিমাণ হিসাবের বাইরে। অলস বসে থাকার কারণে বেসরকারি বাস-ট্রাক মালিকেরা দৈনিক গড়ে ৫৪ কোটি টাকা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। বিআরটিসির হিসাব হলো, সব গাড়ি না চললে প্রতিদিন তারা ৩০ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হন। চালক ও শ্রমিকরা থাকেন বেকার। এসব সূত্রমতে, গত পাঁচ মাসে সারা দেশে প্রায় ৪০০ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার যানবাহন। ৯২টি হামলা হয়েছে রেলের ওপর। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ সরকারি সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বেহিসাবে।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি হুমকির মুখে: গত এক মাসে বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগের নিবন্ধন দেড় শতাধিক থেকে নেমে এসেছে মাত্র ২১টিতে। দেশীয় বিনিয়োগের পরিমাণও কমছে। চলতি মাসেই কুয়েতের আমির  শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহর ঢাকা সফর করার কথা ছিল। ওই সফরে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে তেল শোধনাগার স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, দুলাহাজারা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ নির্মাণসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কুয়েতের বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের আশা ছিল। শ্রমবাজার খোলার আলোচনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১২ই মার্চ কারণ আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনকে কারণ দেখিয়ে ওই সফর বাতিল করে কুয়েত সরকার। ৪ঠা মার্চ দোহায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও কাতারের বিনিয়োগবিষয়ক যৌথ কর্মকমিটির বৈঠকে বাংলাদেশে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ১৭৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় ও চতুর্থ টার্মিনাল, দু’টি হ্যাঙ্গার, কার্গো ভিলেজ, সমান্তরাল রানওয়ে নির্মাণসহ আধুনিকায়নসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৮০ কোটি ডলার আমানত হিসেবে রাখারও প্রস্তাব দেয় কুয়েত সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং যথার্থ বিনিয়োগ পরিবেশকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়ার ইঙ্গিত উঠে আসে আলোচনায়।
রাজনৈতিক কর্মসূচির ফাঁদে পড়তে পারে এইচএসসি পরীক্ষা: আগামী ১লা এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। রাজনৈতিক কর্মসূচির ফাঁদে পড়তে পারে এবারের পরীক্ষা। এসএসসি’র মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচিও ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল ডাকা হয়েছিল। এতে আটটি সাধারণ বোর্ডের অধীনে এসএসসি, মাদরাসা বোর্ডের অধীনে দাখিল এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে দাখিল ভোকেশনাল ও এসএসসি ভোকেশনালের ৩৭টি বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে ২৭ ও ২৮ শে মার্চ দেশজুড়ে হরতাল ডেকেছে বিএনপি  নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোট। আগামী ১লা এপ্রিল থেকে সারা দেশে একযোগে শুরু হবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সূচি অনুযায়ী, ৩০শে এপ্রিল তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা হবে আগামী ২-৫ই  মে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, তারা (রাজনৈতিক দল) যেন পরীক্ষা  দেখে কর্মসূচি দেয়, আমি তাদের এই অনুরোধ করছি। পরীক্ষার সময় রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল দিলে আমাদের অন্য  কোন উপায় থাকে না। হরতালে পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। পাবলিক পরীক্ষার সময়ও হরতাল ডাকার নজির দেখে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানান ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান তাসলিমা বেগম। এইচএসসি পরীক্ষার সময় যদি হরতাল আসে, তাহলে আমাদের বিকল্প মানসিক প্রস্তুতি আছে। শুক্র-শনিবার সহ বন্ধের দিনগুলোতে পরীক্ষা নেয়া হবে। উল্লেখ্য, হরতালের কারণে এসএসসি’র  ক্ষেত্রেও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.