প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ানো জরুরী by মিলু শামস

দশ জানুয়ারি ছাব্বিশ হাজার একশ’ তিরানব্বইটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । দেশ ভাগের পর উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সাল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ধারাবাহিক ইতিহাস নিম্নমুখী।
সাতচল্লিশ সালে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ঊনত্রিশ হাজার ছ’শ তেত্রিশটি। উনিশ শ’ সত্তরে তা নেমে আসে ঊনত্রিশ হাজার ঊনত্রিশটিতে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। সেখানে ঘাটতি থাকলে উচ্চ শিক্ষায় যত চাকচিক্য থাক শিক্ষাব্যবস্থাটা ঠিক মেরুদন্ড সোজাকরে দাঁড়াতে পারেনা। দুভার্গ্যজন ভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর অবস্থা এখনও করুণ। বেসরকারী প্রাথমিকের অবস্থা তো ভয়াবহ। দীর্ঘ দিন ধরে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয় করণের দাবীতে আন্দোলন করছিলেন।
তিয়াত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওতগুলো প্রতিষ্ঠান এক সঙ্গে সরকারী করা সম্ভব নয় বলে সে সময় ধাপে ধাপে করার জন্য কয়েক বছর সময় নেয়া হয়েছিল। সে সঙ্গে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় পাঁচ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল সে সময়ই, উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করা এবং উনিশ শ’ তিরাশি সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। তাদের প্রস্তাব ছিল, আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্বজনীয় বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র একে এ সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব বলেছে। তাদের মতে, এটা করতে হলে সরকারী-বেসরকারীসহ প্রায় আশি হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। দেশের দু’হাজার দু’শটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল চরম দুরবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। এ সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব এসেছে তা বাস্তবায়ন করতে যে টাকা ও অবকাঠামো সুবিধা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতেই ছ’সাত বছর লাগাবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনাও নাকি রয়েছে। কারণ ব্যবস্থাটা তখন দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
যা হোক, আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তারপর এই একচল্লিশ বছরে এবারই একসঙ্গে এতগুলো বিদ্যালয় জাতীয়করণ হলো। এতে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ তিন হাজার আটশ পঁয়তাল্লিশ জন শিক্ষকের চাকরিও সরকারী হলো। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এই শিক্ষকরা আন্দোলন করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয়করণের এ সিদ্ধান্ত তিন ধাপে কার্যকর হবে। প্রথম ধাপে এ মাসের এক তারিখ থেকে বাইশ হাজার ন’শ’ একাশিটি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের একানব্বই হাজার চব্বিশ জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। দ্বিতীয় ধাপে জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে পাবেন স্থায়ী অস্থায়ী নিবন্ধ পাওয়া শিক্ষাদানের অনুমতি পাওয়া কমিউনিটি এবং সরকারী অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দু’হাজার দু’শ’ বায়ান্নটি বিদ্যালয়ের ন’ হাজার পঁচিশ জন শিক্ষক। আর তৃতীয় ধাপে দু’ হাজার চৌদ্দ সালের এক জানুয়ারি থেকে শিক্ষাদানের অনুমতির সুপারিশ পাওয়া ও অনুমতির অপেক্ষায় থাকায় ন’শ ষাটটি বিদ্যালয়ের তিন হাজার সাত শ’ ছিয়ানব্বই জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। এ শিক্ষকরা এতদিন সরকারী শিক্ষকদের মূল বেতনের সমান বেতন পেতেন। সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা হিসেবে দু’শ’ টাকা করে পেতেন। বছরে একটি উৎসব ভাতা পেতেন দু’ভাগে। পেনশন ছিল না। পাশাপাশি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মূল বেতন পাঁচ হাজার পাঁচ শ’ টাকার সঙ্গে এলাকাভেদে বাড়ি ভাড়া পান মূলের শতকরা পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি ভাগ। চিকিৎসা ভাতা সাত শ’ টাকা। টিফিন ও যাতায়াত ভাতা এক শ’ পঞ্চাশ টাকা এবং উৎসব ভাতা বছরে দুটো। এ ছাড়া চাকরি জীবনে তিনটি টাইম স্কেল ও প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট এই এক লাখ তিন হাজার আট শ’ পঁয়তাল্লিশ জন শিক্ষক এখন পর্যায়ক্রমে এ সুবিধাগুলো পাবেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তিন ধাপে জাতীয়করণের খরচ হবে বছরে ছ’শ’ একান্ন কোটি টাকা।
যুগ যুগ ধরে অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষায় এবার গতি আসবে কি? শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থা অনেকখানি দূর হবে তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক চিত্রে মৌলিক পরিবর্তন কতটা আসবে সেটাই ভাবার বিষয়।
শিক্ষকদের গুণগত মানের প্রশ্ন তো আছেই, প্রশ্ন আছে শিক্ষার্থীদের মান নিয়েও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মূলত কারা? অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা এদের মধ্যে কেউ কেউ মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর স্তরে পৌঁছানো এদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছানো তো সুদূরপ্রসারী ঘটনা, প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছতেই ঝরে যায় অনেকে। সামান্য স্বচ্ছল অভিভাবকও সন্তান নিয়ে কিন্ডারগার্টেন বা ওই মানের অন্য স্কুলে ছোটেন। তারা সন্তানের প্রতিদিনের পড়াশোনা তদরকির বিষয়ে প্রখর সচেতন। শিক্ষকদের যে কোন গাফলতিতে তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে জবাবদিহি আদায় করেন। শিক্ষকরাও স্বাভাবিকভাবে পাঠদান বিষয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি সচেতন। সন্তানকে উচ্চশিক্ষার শিখর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েই অভিভাবকরা তার শিক্ষার ভিতের প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত যে অভিভাবক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে পাঠান তার সতেচনতা ওই পাঠানো পর্যন্তই। তিনি জানেন না, সন্তান স্কুলে কি পড়ছে। ভুল শিখছে কিনা। শিক্ষককে ভুলের জন্য অভিভাবকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো বিদ্যা বা অর্থের জোর তার নেই। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যেসব বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানকার শিক্ষকরা অভিভাবকদের চাপে, চৌকস শিক্ষার্থী পাওয়ার আনন্দে বা নিজের আর্থিক জীবনের স্থিতিশীলতার জন্য নিজের পেশার বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সিরিয়াস। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনে এর একটিরও উপস্থিতি নেই। নিজের গুরুত্বপূর্ণ পেশাটি তাই নিজের কাছেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে যেন। গ্রামাঞ্চলের বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেলায় এ কথা আরও বেশি সত্য। রাষ্ট্রের আয়ত্তে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সচল রাখতে হলে এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সাধারণ শিক্ষিত স্বল্প বিত্ত মানুষ ও এখন শহরমুখী। আধুনিক জীপন যাপনের ছোঁয়া বিশষ করে সন্তানের সুশিক্ষার জন্য তারা উর্ধশ্বাসে ছুটছেন শহরে। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করণ অবশ্যই ভাল উদ্যোগ। তবে একে আধুনিক জীবন যাপনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলেই এ থেকে সুফল পাওয়া যাবে। বিদ্যালয়ের মান বাড়ানোর পাশাপাশি এখানে যারা পড়ছে তাদের জীবন যাপনের মানও বাড়াতে হবে। নইলে প্রাথমিক বিদ্যালয় নিস্তরঙ্গই থেকে যাবে। শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী ঝরে যাওয়া রোধ করতে হবে। আজকের সমাজে শিক্ষা লাভজনক পণ্য সে কথা বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার। পণ্য ও প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হবে ছাব্বিশ হাজার নতুন জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। সেভাবেই তৈরি করতে হবে এর যাবতীয় কাঠামো। শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ কথা মনে রাখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.