মানুষ আর মানুষ, বাণিজ্যমেলা জনসমুদ্র- আশপাশে যানজট by রহিম শেখ

বাণিজ্যমেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আসছেন। জনে জনে টইটম্বুর গোটা মেলা প্রাঙ্গণ। শুধুু মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছে রাজধানীর সব মানুষ একযোগে মিছিলে নেমেছে।
সকাল থেকে মিছিলের মতো মানুষ আসতে থাকে মেলাতে। বিকেল হতে না হতেই বাণিজ্যমেলা প্রাঙ্গণ এবং আশপাশের এলাকায় ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটতে হয়েছে তাদের। এ চিত্র ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার তৃতীয় ছুটির দিন শুক্রবারের। এদিন ক্রেতারা এক স্টল থেকে অন্য স্টলে খুঁজেছেন নিজেদের পছন্দসই পণ্য। তাই ক্রেতারা খুশি এক জায়গায় সবকিছু পেয়ে। আর বিক্রেতারা খুশি বিকিকিনি বেশি হওয়ায়। এদিন বাণিজ্যমেলায় রাজধানীর আশপাশের গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী থেকেও এসেছেন অনেকে।
শুক্রবার ছিল মেলার ১৮তম দিন। দুপুরের পর থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। বিকেল হতে না হতেই মেলার সামনের প্রাঙ্গণও পূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় মনে হচ্ছিল বাণিজ্যমেলা নয়, যেন জনসমুদ্র, ঢাকার সব পথ যেন মিশে গেছে এখানে এসে। শেষ বিকেলে আগত যারা তাদের প্রায় ঘণ্টাখানেক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ টিকেট কাটতে হয়েছে। সন্ধ্যার পর রংবেরঙের আলোর ঝলকানিতে মেলা প্রাঙ্গণ হাজার হাজার নারী-পুরুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। দুপুরের দিকে পুরোপুরি মেলা জমে উঠে।
মেলার গেট ইজারাদারদের দেয়া তথ্য মতে জানা যায়, শুক্রবার প্রায় দুই লাখ ক্রেতা-দর্শনার্থী মেলায় এসেছেন। এদিকে প্রচুর লোক সমাগম হওয়ায় মেলার আশপাশের সড়কে সারাদিনই যানজট লেগে ছিল। এদিন দুপুরের পর থেকে সংসদ ভবন ও খামারবাড়ী সংলগ্ন মোড় থেকে মানুষ হেঁটেই অনেকটা মিছিলের মতো মেলায় আসতে থাকে। অপরদিকে মিরপুর থেকে আসা মানুষ আগারগাঁও মোড় থেকেই হাঁটা শুরু করে। কারণ এ রাস্তায় দুপুরের পর থেকে যানবাহনের জটলা ও জ্যাম তৈরি হয়। এ ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণের ঠিক সামনের সড়কেও যানবাহনের দীর্ঘ জট লক্ষ্য করা গেছে। এ সময় যারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এসেছেন তারাও কম ভোগান্তিতে পড়েননি। প্রধান সড়ক থেকে মেলার সামনে আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। এদিকে মেলার প্রবেশপথেও ব্যাপক লোক সমাগমে হিমশিম খেতে হয় শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের। টিকেট কাউন্টারের সামনে তৈরি হয় লম্বা লাইন ও জটলা। পরিবার নিয়ে আসা অনেককে স্ত্রী-সন্তানদের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে লাইনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাণিজ্যমেলায় বিভিন্ন ধরনের ছাড়ের সুবিধা দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেকে আবার আগের সঙ্গে নতুন করে ‘বিশেষ ছাড়’ যোগ করেছে। এদিকে নারী ও তরুণীদের বেশি কেনাকাটা করতে দেখা গেছে মেলাতে। যেসব প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ইমিটেশনের গহনা, মেয়েদের পোশাক, কাশ্মিরী শাল ও চাদর, প্রসাধন সামগ্রী, প্লাস্টিকপণ্য, গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে সেসব স্টলে ভিড় ছিল বেশ। মেলায় জুয়েলারি, ক্রোকারিজ, ইলেকট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাণিজ্যমেলায় এবার ১২টি বিদেশী স্টল রয়েছে। এসব স্টলে শাল, শাড়ি, জুয়েলারি পণ্য ও শোপিসের চাহিদাই বেশি। এছাড়া পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভারত, তুরস্কের স্টলে বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর পদচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। মেলার ইলেট্রনিক পণ্যের চাহিদা ছিল উল্লেখ করার মতো। ওয়ালটন, সনি, ট্রান্সকম, ইলেক্ট্রা, কংকা, প্যানাসনিকসহ বিভিন্ন নামীদামী স্টলে সারাদিনই ভিড় লেগেছিল। অনেক প্যাভিলিয়নে দেখা গেছে ক্রেতাদের লাইন দিয়ে ঢুকতে। মেলাতে অপেক্ষাকৃত কম দামী বিশেষ করে ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, প্রেসার কুকার, টোস্টার, ওভেন, আয়রন, রুম হিটার, হটপট ইত্যাদির চাহিদা ছিল বেশি। মোটরসাইকেলের দিকে তরুণদের বেশি ঝোঁক ছিল। ওয়ালটন প্যাভিলিয়নের ইনচার্জ আক্তারুজ্জামান অপু জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম দিন থেকেই মেলায় বিকিকিনি ভাল হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার বিক্রি বেশি হবে বলে তিনি আশা করেন। ফার্নিচারের স্টলগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় ছিল উল্লেখ করার মতো। অটবী, হাতিল, ব্রাদার্স, গ্রীন, আখতার ফার্নিচারসহ কয়েকটি ফার্নিচার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেলা উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেয়ায় বিকেলের দিকে এসব স্টলে লাইন দিয়ে দর্শনার্থীরা ঢুকেছেন। শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা, শার্ট-প্যান্টের স্টলে অল্পবয়সী ও মধ্যবয়সী নারীদের প্রচ- ভিড় ছিল। এবারের মেলায় রাজশাহী সিল্ক, প্রাইড, শালিমারসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য তুলেছে। এসব স্টলে বিক্রিবাট্টা বেশি ছিল। এছাড়া মেলায় এবার প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল ও বাচ্চাদের খেলনার চাহিদা ব্যাপক। বেঙ্গল, আরএফএল, তালুকদার, গাজীসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যের স্টলে সারাদিনই ভিড় ছিল।
মেলায় কেনাকাটা করতে আসা নব-দম্পতি আবিদ ও পপির সঙ্গে দেখা হলো পাকিস্তানি স্টলে। এ দম্পতি মেলায় এসেছেন সূদুর গাজীপুর থেকে। মেলায় এত স্টল থাকতে বিদেশী স্টল থেকে কেনাকাটার কারণ জানতে চাইলে তারা জনকণ্ঠকে জানান, একমাত্র বাণিজ্যমেলা এলেই কিছুটা কম মূল্যে বিদেশি পণ্য কেনার সুযোগ থাকে। তাই দেশী পণ্যের পাশাপাশি বিদেশী স্টলগুলোতে দেখেশুনে প্রসাধনী বা কাপড়-চোপড় কিনছি। সেই সঙ্গে বিশাল পণ্যভার থেকে পছন্দের জিনিসটি কেনার সুযোগ তো থাকছেই। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে সকালে আশরাফুল ইসলাম সস্ত্রীক মেলায় এসেছেন। তার হাতের ৪টি বড় ব্যাগ দেখে বোঝা যায় তিনি অনেক কিছু কেনাকাট করেছেন। গেন্ডারিয়ার পাপিয়া ইয়াসমিন জানান, শাহবাগ থেকে যানজট অতিক্রম করে মেলায় আসতে হয়েছে। তিনি জানান, প্রতিবারই ছুটির দিনে মেলায় আসি। এবার একটু বেশি ভিড় মনে হচ্ছে। মেলায় এলে একই স্থানে সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। যাচাই-বাছাই করে পণ্য কেনা যায়। মেলার আগতদের বেশিরভাগই শুধু ঘুরতে এসেছেন। তবে ছুটির দিন হওয়ায় অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেলায় এসেছেন। বিভিন্ন কোম্পানির বিশেষ ছাড়ের সুযোগে অনেকে কিনেছেন পছন্দমতো পণ্য। তবে সন্ধ্যার পর যারা দল বেঁধে এসেছেন, তারা মেলার মাঠে বসেছেন আড্ডায়।
এদিকে প্রথম দিকে মেলায় হকারের উৎপাত চোখে না পড়লেও শুক্রবার প্রচুর মানুষের ভিড়ে অনেক হকারকে দেখা যায়। আলুর চিপস, মুড়িমাখাসহ বিভিন্ন পণ্য তারা মেলা কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করছে। প্রতিদিনের মতো এদিনও দর্শনীয় প্যাভিলিয়নগুলোর সামনে ছিল লক্ষণীয় ভিড়। কেনা-কাটার পাশাপাশি স্পিড, মার্কস, শতরঞ্জি, ওয়ালটনসহ বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ছাড়াও বিভিন্ন ফোয়ারা, সুন্দরবন ইকোপার্ক, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি প্যাভিলিয়নের সামনে দর্শনার্থীদের ছবি তুলতে দেখা যায়। এবার মেলায় যথেষ্ট খোলা-মেলা জায়গা রাখায় অনেকে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন অনেকে। মেলার ঠিক মাঝখানে বড় টাওয়ারের চারপাশে প্রচুর জায়গা ও বসার ব্যবস্থা থাকায় কেনা-কাটার মাঝখানে বিশ্রাম নিতে দেখা যায় ক্রেতাদের।

No comments

Powered by Blogger.