গ্রামীণ চুলায় প্রচলিত জ্বালানিতে বায়ু দূষণ বেশি হয়- কমানো গেলে বেঁচে থাকার হার বাড়বে ॥ গবেষণা প্রতিবেদন by নিখিল মানখিন

 অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২০ লাখ লোকের মৃত্যু ও রোগের মোট ব্যাপকতার ২.৭ শতাংশের জন্য দায়ী। হৃদরোগজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতার ওপর অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।
নিরেট জ্বালানি ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণের সংস্পর্শ কমাতে পারলে মানুষের বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। স্বল্প আয়ের গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ১০ বছরমেয়াদী পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব স্বল্পোন্নত দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ রান্না করা ও উত্তাপ সৃষ্টির জন্য এখনও নিরেট জ্বালানি ব্যবহার করে, সেসব দেশে অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের কারণে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে কম পরিমিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ, গোবর, তুষ প্রভৃতি পোড়ানোর ফলে রান্নার জায়গার চারপাশে এবং থাকার ঘরে ঘনভাবে দূষক পদার্থ উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ রান্নার কাজ ও উত্তাপ সৃষ্টি করার জন্য নিরেট জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এ দেশে প্রচলিত চুলায় ব্যবহৃত জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের তথ্য পর্যাপ্তভাবে নথিভুক্ত থাকলেও প্রাপ্তবয়স্কদের হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের বিষয়টি ভালভাবে জানা নেই। নিরেট জ্বালানির সাহায্যে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ শ্বসনতন্ত্রের রোগ ও হৃদরোগজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর একটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। নব্বই দশকের শুরুর দিক থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকা মতলবে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে, যার ফলে হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগজনিত কারণে মৃত্যুর হারের ওপর অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের প্রভাব অনুসন্ধানের জন্য একটি সাধারণ গবেষণা চালানো সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের শ্বসনতন্ত্রের রোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের সঙ্গে জ্বালানির ধরনে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। আইসিডিডিআরবির গবেষকরা মতলবের ১১টি গ্রামের সব পরিবারকে চিহ্নিত করেন এবং তারা ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রান্না ও গরম করর জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস না নিরেট জ্বালানি ব্যবহার করছে, তার ভিত্তিতে তাদেরকে দু’শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। মতলবের স্থায়ী জরিপের অংশ হিসেবে তাদের দেয়া বিবৃতির মাধ্যমে হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগসহ ব্যক্তিক পর্যায়ে মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। নির্ধারিত ১১টি গ্রামের ৮ হাজার ৭৩টি পরিবারের মধ্যে ৫০৮টি পরিবারের ১ হাজার ৫৮০ জন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য তরল প্রোপেইন গ্যাস ব্যবহার করত। দশ বছরে ১ হাজার ৭২১ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ১ হাজার ৬১৭ জন নিরেট জ্বালানি ব্যবহারকারী পরিবারের সদস্য এবং ১০৪ জন সরবরাহকৃত গ্যাস ব্যবহারকারী পরিবারের সদস্য। হৃদরোগ, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, প্লীহার রোগ ও ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন রোগের কারণে ১ হাজার ২৪১ জনের মৃত্যু হয়, যা মোট মৃত্যুর ৭২ শতাংশ। অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর মধ্যে ৭৭৭ জন হৃদরোগ ও ১৬৯ জন শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণে মারা যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন রোগের মধ্যে সেরিব্রোভাস্কুলার রোগের কারণে মৃত্যু হয় ৩৬৩ জনের, যা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ১৮৩ জনের মৃত্যু হয় ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্ট এ্যাটাকের কারণে। শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণে মৃত্যুর মধ্যে ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং এর আনুষঙ্গিক অসুস্থতার কারণে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়। ৮৫ জনের মৃত্যু হয় শ্বসনালীর সংক্রমণের মাধ্যমে। শাসনতন্ত্রের অন্যান্য রোগের কারণে আরও ২৭ জনের মৃত্যু হয়। সর্বমোট ৯৪৬ জনের মৃত্যু হয় বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগের কারণে। এর মধ্যে ৮৮৪ জনের বাড়িতে নিরেট জ্বালানি ব্যবহার করা হতো এবং ৬২ জনের বাড়িতে গ্যাস ব্যবহার করা হতো।
গবেষকরা আরও জানান, যানবাহন ও কলকারখানার মাধ্যমে সৃষ্ট দূষণমুক্ত বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ অঞ্চলে নিরেট জ্বালানির ব্যবহার হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগসহ প্রায় সব ধরনের অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। এ দেশের যানবাহন ও কলকারখানার দ্বারা সৃষ্ট দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব গ্রামাঞ্চলে কম পড়লেও নিরেট জ্বালানির ব্যবহার এসব অঞ্চলের অধিবাসীদের হৃদরোগ ও শ্বসনতন্ত্রের রোগে সমন্বয়ে মৃত্যু অথবা পৃথকভাবে হৃদরোগ বা শ্বসনতন্ত্রের রোগজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

No comments

Powered by Blogger.