রোকেয়া ভার্সিটি ভিসির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল জলিল মিয়ার মেয়ে রোমানা ফেরদৌসী জলিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা।
ভাই মাহবুবুর রহমান ৩য় শ্রেণীর হিসাব সহকারী পদে যোগদান করে পরবর্তীতে মাত্র এক বছরের মধ্যে কয়েকটি পদ ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতি নিয়ে তিনি হিসাব শাখার কর্মকর্তা এখন। তিনি দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে সনদ দিয়ে এ পদোন্নতি নেন। কিন্তু কোনভাবেই তা আইনসিদ্ধ নয়। ভায়রা গাজী মাজহারুল আনোয়ার এক বছর আগে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকলেও সহকারী থেকে রাতারাতি বনে যান সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর এই পদোন্নতি বোর্ডে ছিলেন তাঁরই অপর দুই ভায়রা। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৬(৫) ধারা অনুযায়ী কোন অনুষদের ডিন হবেন সংশ্লিষ্ট অনুষদভুক্ত বিভাগসমূহের জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক। আর অধ্যাপক না থাকলে জ্যেষ্ঠতম সহযোগী অধ্যাপক। কিন্তু সে আইন ভঙ্গ করে দু’জন সহযোগী অধ্যাপককে ডিঙ্গিয়ে উপাচার্য তাঁর ভায়রা ড. মাজহারুল আনোয়ারকে ডিন বানিয়েছেন। অপর ভায়রা আশরাফুল আলম স্নাতকোত্তর প্রথম পর্ব করে হিসাব শাখার সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। নিয়ম অনুযায়ী অনার্স ও স্নাতকোত্তর ছাড়া এ পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু শুধু আত্মীয়তার সুবাদে শর্ত শিথিল করে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার অপর ভায়রার মেয়ে মনিরা খাতুন নিয়োগ পেয়েছিলেন কম্পিউটার অপারেটর পদে। নিয়োগ শর্ত না মেনেই কম্পিউটার অপারেটর পদ থেকে সরাসরি তাঁকে সেকশন অফিসার গ্রেড-১ এ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আরেক ভায়রার মেয়ে আরা তানজিয়া ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক। আর আপন খালাত ভায়রা শাহ রেজাউল করিমের অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি এ্যাডহকে নিয়োগ পেয়েছিলেন হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে। পরবর্তীতে ওই পদে তাঁর চাকরি স্থায়ী না হলেও রাতারাতি তিনিও বনে যান হিসাব শাখার সহকারী পরিচালক। ওই পদে তাঁর চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই তিনি উচ্চতর স্কেল লাভ করেন। তাঁর বড় ভাইয়ের মেয়ে সীমা খাতুন সংস্থাপন শাখার কম্পিউটার অপারেটর। নিকটাত্মীয় সুভেনির বেগম এবং তাহমিনা খাতুন লিপিকে দেয়া হয়েছিল ওয়াজেদ রিসার্স ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার অপারেটর পদে। মধ্যবর্তী একাধিক পদ ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতি পেয়ে এখন তারা দু’জনেই গ্রেড-১ এ সেকশন অফিসার। আপন ভাগ্নে সোহেল রানা কম্পিউটার অপারেটর আর ভায়রা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভগ্নিপতি হুমায়ুন কবীরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে। নিয়ম ভঙ্গ করে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে শাহজাহাল ম-ল নামে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভিসির খুব কাছের লোক হওয়ায় মূল পদের বাইরে তাঁকে এখন ‘রেজিস্ট্রার’ এর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ভিসির আত্মীয়করণের ওপরের এই চিত্র একাংশ মাত্র। এ ছাড়াও রয়েছে নিজ বাড়ি পীরগঞ্জ এলাকাপ্রীতি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছে, তাদের সিংহভাগই পীরগঞ্জ এলাকার। সম্প্রতি জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘এতদিন জানতাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পীরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এখন দেখছি এর নাম জলিল মিয়া পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়।’ অভিযোগ উঠেছে, উপাচার্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পারিবারিকীকরণ করে গড়ে তোলেননি, বরং ক্রমেই এর ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করছেন। পরিণতিতে এ অঞ্চলবাসীর অনেক সাধনার ফসল রংপুর তথা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভিত্তি তা দুর্বলভাবে গড়ে উঠছে। আর এসব কারণে ক্রমেই আন্দোলনমুখর ও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত পারিবারিকীকরণ, অবৈধ নিয়োগ এবং অবৈধভাবে গড়ে তোলা ‘নর্থ বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ (নিডস) কার্যক্রম নিয়েই এই জনক্ষোভ। অভিযোগ রয়েছে, চলতি মাসের ১ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত এক থেকে দেড় শ’ জনের মতো কর্মচারীকে এ্যাডহকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এতে করেই গড়ে ওঠে এই আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে নিডসের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও নিয়োগ থেমে নেই। আন্দোলন এবং সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গত ১০ জানুয়ারি রাতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেও আজ শনিবার যথারীতি লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনিক কাজ বন্ধ থাকলেও নিয়োগ পরীক্ষা চলে কি করে?
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভিসির এসব অনিয়ম, পারিবারিকীকরণ, স্বেচ্ছাচারিতার নানা কর্মকা- নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশনে একের পর এক ফলাও করে সংবাদ প্রচার হলেও কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে এসবের কোন তদন্ত কিংবা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে গত জুলাই মাসে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও বর্তমানে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তা এখন হিমাগারে।
জানা গেছে, এ অঞ্চলবাসীর সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির বিভাগীয় প্রধান ড. লুতফর রহমান। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ৫ মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ১৭ মে বর্তমান ভিসি আব্দুল জলিল মিয়া এখানে যোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এখানে যোগদানের পরই কতিপয় অধ্যাপক-শিক্ষক এবং কিছু নেতার নিয়ে গড়ে তোলেন দলীয় ও বাণিজ্যকরণের একটি সিন্ডিকেট। আর দেশবরেণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক, সাংবাদিক এবং আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আমন্ত্রণ করে একটি অনুষ্ঠানে এনে তাঁকে করা হয়েছিল আমন্ত্রিত অতিথি। আক্ষেপ করে ওই ছাত্র জানান, কোথায় গাফ্্ফার চৌধুরীর অবস্থান আর কোথায় ভিসি জলিল মিয়া! নিছক ভদ্রলোক বলেই সেদিন বিষয়টিকে মেনে নিয়েছিলেন আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী।
জানা গেছে, এটিজিএম গোলাম ফিরোজকে ২৬ দিনের ব্যবধানে দুটি পদে দুই বার এ্যাডহক নিয়োগ দেয়া হয়। প্রথমে পিএস টু ভিসি পদে নিয়োগ দিয়ে ২৬ দিন পর আবার উপাচার্য নিজের স্বাক্ষরে উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে এ্যাডহক নিয়োগ দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা নিয়োগের শর্ত পূরণ করতে পারেন না, তাদের প্রথমে এ্যাডহক নিয়োগ দিয়ে পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ প্রার্থী হিসেবে শর্ত শিথিল করে তাদের নিয়োগ বৈধ করা হচ্ছে। ফলে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষ জনবল নিয়োগ অভাবে এর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি দুর্বল হয়ে থাকছে। হলের কার্যক্রম না থাকলেও দুটি হলের প্রাধ্যক্ষ এবং আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৯(১) ধারা অনুযায়ী বছরে ন্যূনতম একবার করে সিনেট সভা হওয়ার কথা থাকলেও বিগত চার বছরে একবারও সিনেট সভা হয়নি। নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ কর্তৃপক্ষকে সচেতনভাবেই অচল করে রাখা হয়েছে। কারণ সিনেট সভা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি, সংবিধি, প্রবিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন হবে। এতে করে স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর হলেও এখানে কোন বিধি, সংবিধি, প্রবিধি ও কোনরূপ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।
জানা গেছে, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর হয়েছে, এ সময়ে শিক্ষার্থীদের মেধা গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে এমন কিছুই করা সম্ভব হয়নি। এর উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা সম্মান কোর্স স¤পন্ন করতে চলেছে কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত বই কেনা হয়নি, আবাসিক ব্যবস্থাসহ অনেক কাজই করা হয়নি। কিন্তু সে সবের দিকে নজর না দিয়ে আইন লঙ্ঘন করে শিক্ষাবাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পদে বিশেষ করে রেজিস্ট্রার, গ্রন্থাগারিক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভাগ এখনও খোলাই হয়নি সেসব বিভাগেও শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। অভিযোগ রয়েছে, মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই দর্শন বিভাগে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্র সংসদ, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা হলেও ওই অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় না করে ভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়।
উপাচার্য তাঁর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে আত্মীয়করণ, পীরগঞ্জীকরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন কিছুই অনিয়ম করা হয়নি। আত্মীয় এবং এলাকাবাসী যদি নিয়ম এবং যোগ্যতার মধ্যে নিয়োগ পায় তবে কার কী করার থাকে। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত হোক। তদন্তেই প্রমাণিত হবে আমি দুর্নীতিবাজ কি না।

No comments

Powered by Blogger.