কলকাতায় বাংলা গানের স্বর্ণযুগ স্মরণ করিয়ে দিল বাংলাদেশই- সিটিসেল- চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডস by মোরসালিন মিজান

আগে বলতে হবে শহর কলকাতার কথা। দারুণ এগিয়ে গেছে এই জনপদ। জৌলুস বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। এখন যে দিকে চোখ যায়, উন্নতির ছোঁয়া। বাঙালীর শৌর্য বীর্য। তবে এত কিছুর পরও সত্য যে, এখানে ভাল নেই বাংলা।
হিন্দি আর ইংরেজীর দাপটে রীতিমতো কোণঠাসা। অসহায়। একই অবস্থা বাংলা সঙ্গীতের। এক সময় যে কলকাতা বাংলা গানের স্বর্ণযুগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েছিল সে শহর ধুঁকছে এখন। মার্কেটে শপিংমলে হিন্দি সিনেমার গান। পাশাপাশি ইংরেজী। হ্যাঁ, বাংলাগানও অনেকে করছেন। ভীষণ ভাল করছেন কেউ কেউ। তাতে কি? শোনার খুব কেউ নেই। একই কারণে পেছন ফিরে তাকানোর সময় পায় না কলকাতার নতুন প্রজন্ম। বাংলা গানের সমৃদ্ধ ইতিহাসটি সম্পর্কে অল্পই জানে তাঁরা। বাংলা গানের যুগ স্রষ্টারা তাই আড়ালে চলে যান। নিজেদের গুটিয়ে রাখেন। যেন আর কিছু করবার নেই তাদের। পাওয়ার নেই কারও কাছ থেকে কিছু।
এবার আসা যাক সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডস প্রসঙ্গে। এতক্ষণ যে বাস্তবতা বর্ণনা হলো সে বাস্তবতার মধ্যেই গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশী আয়োজকরা কলকাতায় আয়োজন করেন অষ্টম সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডসের বিশেষ পর্বটি। সঙ্গত কারণেই দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এ আয়োজন। এর আগে নিয়মিতভাবে দেশে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এবার ছড়িয়ে দেয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ অবধি। বিখ্যাত ওবেরয় গ্র্যান্ডে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান গায়িকা রুনা লায়লাকে ছাড়াও আজীবন সম্মাননা জানানো হয় কলকাতার কিংবদন্তি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। এ আয়োজন বাংলাগানের স্বর্ণালি যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শ্রোতাদের। শতত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া কলকাতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এক সময় বাংলা গানের ছিল এই শহর। অসংখ্য কালজয়ী গান এখান থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। কিংবদন্তি শিল্পীরা জন্মেছেন এই শহরে। তাঁদের সৃষ্টির পথ ধরে রচিত হয়েছে বর্তমান। কিংবদন্তি সেই সব শিল্পীদের অবদান সম্পর্কে জানা এবং তাঁদের সম্মান জানানোর বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে এ অনুষ্ঠান। জানিয়ে দেয়া হয়, বাংলা গানের গৌরবের ইতিহাসটি খুঁজে নিতে পারলে, যুগ সৃষ্টিতে অবদান রাখা শিল্পীদের সম্মান জানাতে পারলে আপন পথে পা ফেলতে শিখবে নতুন প্রজন্ম। হ্যাঁ, অষ্টম সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডস প্রদান অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যটি বলতে হবে এখানেই। সাফল্যের আরেকটি দিকÑ এতে দুই বাংলার শিল্পীদের একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও রুনা লায়লা একই মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়ান। বহু দিনের যে সম্পর্ক যতেœর অভাবে পুরনো হতে চলেছিল সে সম্পর্কটিকে ঝালাই করে নেয়ার চেষ্টা করেন শিল্পীরা। দারুণ আবেগে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেন। শুধু কি তাই? রুনা লায়লার মুখখানা কাছে টেনে নিয়ে চুমু খান তাঁর প্রিয় সন্ধ্যাদি। এ দৃশ্য বলে দেয়Ñ মনের দিক থেকে এখনও কতো কাছাকাছি দুই বাংলার শিল্পীরা। বলা বাহুল্য, এ মনের টানেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও রুনা লায়লাকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাতে কলকাতায় উড়ে গিয়েছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী শাহীন সামাদ, সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, ফাতেমা তুজ জোহরা, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, এমএ মান্নান, লিনা তাপসী খানসহ এক ঝাঁক শিল্পী। ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতারাও ছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে গুণী দুই শিল্পীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি. চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও সিটিসেলের সিইও মেহবুব চৌধুরী। পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি শিল্পীদ্বয়কে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। এ সময় সকলে আসন ছেড়ে ওঠে দাঁড়ান। সম্মান জানান প্রিয় দুই শিল্পীকে। এ সময় উপস্থিত সকলে ভুলে যান জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গ নাকি ঢাকা! তাঁদের চোখের সামনে দুই বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
৮২ বছর বয়স্ক সন্ধ্যার কথাতেও দুই বাংলার সম্পর্কটি বড় হয়ে উঠে। বার বার তিনি বলার চেষ্টা করেন বাংলাদেশের সঙ্গে কী গভীর সম্পর্ক তাঁর। নানা স্মৃতি রোমন্থন করে এদিন শিল্পী বলেন, বাংলাদেশের শিল্পীদের গান আমি বহুকাল ধরে শুনছি। আব্দুল জব্বার, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, মুস্তাফা জামান আব্বাসী কতো কতো নাম। অনেকের সঙ্গে এই এখনও মধুর সম্পর্ক আমার। বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকে আমার গানকে বাংলাদেশের মানুষ কত ভালবাসেন তা আমি জানি। তারা যে কতভাবে তাঁদের সেই ভালবাসার কথা আমাকে জানান তা বলে বোঝাতে পারব না। মাঝে মাঝে আমি কলকাতার মানুষকে তো বলি, আমার দেশ আসলে বাংলাদেশ। ওরাই আমাকে সত্যিকারের ভালবাসে। অবশ্য এ প্রশ্নও ওঠেÑ কেন তবে বাংলাদেশে পাওয়া যায় না তাঁকে? উত্তরে প্রবীণ শিল্পী রাখঢাক না করে অনেকটা শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে বলেন, বহু কাল আগে বাংলাদেশ থেকে আমাকে কিছু লোক গান করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক দিন আগে তারা জানান, অনুষ্ঠানটি হচ্ছে না। ঘটনাটা তখন আমাকে বেশ কষ্ট দিয়েছিল। পরে অনেক আমন্ত্রণ পেলেও আর যাওয়া হয়নি। অনেকটা কুসংস্কারের মতোই আমার মনে হতো বাংলাদেশে গান করা ভাল হবে না আমার জন্য। তবে বিদেশের মাটিতে বরাবরই তিনি বাংলাদেশী ভক্ত বেশি পেয়েছেন বলে জানান। এতকাল পরে কলকাতায় গিয়ে তাঁকে সম্মাননা জানানোয় সংশ্লিষ্টদের কৃতজ্ঞতা জানান শিল্পী। অনুষ্ঠানে প্রিয় সন্ধ্যাদির পাশে দাঁড়িয়ে আজীবন সম্মাননা গ্রহণ করাকে নিজেরে জীবনের একটি বড় ঘটনা বলে জানান রুনা লায়লা। বলেন, সন্ধ্যাদির সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আজ আরও একবার অনুভব করলাম আমি।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বেও দুই বাংলার মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় গান করেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান নজরুলসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। একই মঞ্চে কলকাতার শিল্পীদের হয়ে গান করেন সেখানকার জনপ্রিয় গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য। সব মিলিয়ে দুই বাংলার শিল্পীদের অনন্য সুন্দর একটি মিলনমেলা হয়ে ওঠে সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডস।
তবে শেষ করতে হবে শুরুর প্রসঙ্গটি টেনে। এত চমৎকার একটি আয়োজন। কিন্তু এ আয়োজনে খুব আগ্রহ নিয়ে একাত্ম হতে আসেননি কলকাতার বর্তমান বা পূর্ব প্রজন্মের কোন শিল্পী। পরের দিন স্থানীয় দৈনিকগুলোতে এ সংক্রান্ত কোন খবরও ছাপা হয়নি। ফলে হতাশ হয়েছেন কেউ কেউ। বাকিরা আশ্রয় করেছেন সদ্য প্রয়াত কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই লেখক বলে গিয়েছিলেন, বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলাদেশই। সুতরাং সে দ্বায়িত্ব পালনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বিদগ্ধজনেরা।

No comments

Powered by Blogger.