’৭১-এর গণহত্যার বিচার ॥ সামনে অনেক বাধা by শাহরিয়ার কবির

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশ সরকার যখন গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন থেকেই এই বিচার প্রশ্নবিদ্ধ, বিঘিœত ও বানচালের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে ও বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা শুরু করেছে।
জামায়াত জানে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত এসব অপরাধের সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যেভাবে যুক্ত ছিল জামায়াতের তৎকালীন নেতাকর্মীরাও একইভাবে যুক্ত ছিল। কখনও এসব অপরাধের ক্ষেত্রে জামায়াত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চেয়ে বেশি নৃশংস ছিল।
পাকিস্তানী শাসকরা তাদের ২৪ বছরের শাসনামলে বাঙালীদের সব সময় নিকৃষ্ট ও ভৃত্যতুল্য গণ্য করেছে। বাঙালীর সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তারা প্রতিহত করতে চেয়েছে ইসলাম ও পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার দোহাই দিয়ে। ’৭১-এ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানও ছিল অভিন্ন। এই রাজনীতি বাংলাদেশে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করেছে, এসব অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে এবং এখনও এই রাজনীতি বাংলাদেশে অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক বিশ্বে ইসলামের নামে হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাসকে বৈধতা দিয়েছে মিসরে হাসান আল বান্না কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ইখওয়ানুল মুসলেমিন’ বা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং অখ- ভারতবর্ষে মাওলানা আবুল আলা মওদুদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামী’। ইসলামের নামে জেহাদী সন্ত্রাসের চরম অভিব্যক্তি ছিল ’৭১-এর গণহত্যা ও নির্যাতন। জেহাদের নামে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে নয় মাস সময়ের ব্যবধানে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা, ২ লাখ নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন এবং ১ কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গণহত্যার ৪০ বছর পর যখন এর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তখন অভিযুক্তরা নির্বিবাদে তা মেনে নেবে এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই, বিশেষভাবে অভিযুক্তদের সংগঠন যখন আন্তর্জাতিক জেহাদী বলয়ের অপরিহার্য অংশ। উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘জামায়াতে ইসলামী’, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘জামা-আল ইসলাম’ এবং মধ্য এশিয়ার ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ নিবিড় সংযোগ রক্ষার মাধ্যমে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশে কাজ করছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের যে আল-কায়দা ও তালেবানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা জগৎ ‘ওয়ার অন টেরর’ ঘোষণা করেছে তারা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও ‘জামায়াতে ইসলামী’র ভাবশিষ্য। খোমেনি, মওদুদী, সাইয়িদ কুতুব, হাসান আল বান্না থেকে শুরু করে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব ও ইবনে তায়মিয়া এদের আদর্শিক গুরু। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের অবসানের পর যে আদর্শিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি পূরণের জন্য আবির্ভূত হয়েছে রাজনৈতিক ইসলাম তত্ত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা তাদের প্রধান রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন মুসলমানপ্রধান দেশে এই রাজনৈতিক ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার সময় এ কারণেই আমেরিকা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশে ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ যৌক্তিক কারণেই আমেরিকা এবং মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওআইসি’র কিছু সদস্য সহজভাবে গ্রহণ করেনি। কারণ, তারা জানে এই বিচার ’৭১-এর গণহত্যার ভয়াবহতা ও ব্যাপকতার পাশাপাশি হত্যাকারীদের রাজনীতি এবং তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থকদের মুখোশ উন্মোচন করবে।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ’৭১-এর প্রসঙ্গ এখনও উপেক্ষিত বিষয়। আমেরিকার পাশাপাশি সৌদি আরব ও তুরস্কের নেতৃত্বে ওআইসির দেশগুলো কীভাবে তাদের প্রধান মিত্র পাকিস্তানকে ’৭১-এ মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যায় সহায়তা করেছে এটি আলোচিত হলে বিড়ম্বিত হতে হবেÑএই ভয় থেকেই তারা গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। ২০১১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিফেন র‌্যাপ একাধিকবার বাংলাদেশে এসে এ কথাই সরকার ও নাগরিক সমাজকে বোঝাতে চেয়েছেনÑজামায়াত ইসলামী একটি ‘মডারেট ইসলামী দল’, ’৭১-এর গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এর বিচার ঠিক হবে না। ২০১২-এর ডিসেম্বরে স্বয়ং তুরস্কের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে প্রধান অভিযুক্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে মৃত্যুদ- না দেয়ার কথা বলেছেন। সৌদি আরব, পাকিস্তান ও মিসরে জামায়াতের সহযোগীরা সর্বাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে গোটা ‘ওআইসি’কে এই বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার জন্য। এই বিচার বন্ধের জন্য জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা কীভাবে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে, কীভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তারা লবিং করছে এর বিবরণ জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক ‘সংগ্রাম’ ও ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা কোথাও দৃশ্যমান নয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে যখন দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় তখন জামায়াতের প্রধান মতিউর রহমান নিজামী একবার বলেছিলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে জামায়াত এই সরকারকে সমর্থন করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গত ২১ বছর ধরে দেশে ও বিদেশে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বহু সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার মহাজোট প্রধানত এ কারণেই বিশাল বিজয় অর্জন করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তবে বিচার কীভাবে হবে এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভেতর বিভ্রান্তিও কম ছিল না। যে কারণে ১৯৭৩-এর আইন অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
সভ্য মানুষ যখন থেকে যুদ্ধের আইন ও বিধান প্রবর্তন করেছে তখন থেকে এসব লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে, যা সাধারণভাবে যুদ্ধাপরাধ নামে পরিচিত। আধুনিক আইনে ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘আগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনা’ প্রথম সংজ্ঞায়িত হয়েছে নুরেমবার্গের ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে’ যা ‘নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নাৎসিদের প্রধান ঘাঁটি নুরেমবার্গে এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দি ফার ইস্ট’ যা ‘টোকিও ট্রাইব্যুনাল’ নামে পরিচিত। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লাইপজিগে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ প্রহসনে পরিণত হয়েছিল প্রয়োজনীয় আইন এবং উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার অভাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বহু দেশে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু বাংলাদেশের আগে কোন দেশ এসব অপরাধের বিচারের জন্য নুরেমবার্গ বা টোকিওর মতো বিশেষ আইন ও আদালত গঠন করেনি। যে আইনের অধীনে বর্তমানে ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার হচ্ছে এই আইন বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়েছে ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩’ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নুরেমবার্গ ট্রায়াল’, ‘টোকিও ট্রায়াল’ ও ‘ইয়ামাশিতা ট্রায়াল’ (ম্যানিলা)-এর মডেলে এই আইন প্রণীত হয়েছে এবং এসব আইনে যে সীমাবব্ধতা ছিল সেগুলো বাংলাদেশের আইনে অতিক্রম করা হয়েছে। এই আইন ভবিষ্যতে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ বা বাতিল করতে না পারে এর জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমবারের মতো সংশোধন করেছিলেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে ’৭১-এর ঘাতক দালালদের চলমান বিচার বন্ধ করে দিলেও ’৭৩-এর আইন বাতিল করতে পারেননি এর সাংবিধানিক সুরক্ষার কারণে।
জামায়াত যখন বুঝেছে ’৭৩-এর আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার হলে পরিত্রাণের কোন উপায় থাকবে না তখন থেকে তারা এই আইনের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে অপপ্রচার শুরু করেছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানীদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশীদের বিচারের যথার্থতা, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা, ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিকে বিচার না করে ফেরত দেয়া, ৪০ বছর পর বিচারের যৌক্তিকতা, ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া, এই বিচার বিরোধী দল দমন এবং ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ ইত্যাদি বলে বিচার বিঘিœত, বিলম্বিত ও বানচালের জন্য এক বিশাল ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশকে বিভ্রান্তও করতে পেরেছে। আমরা জামায়াতের উত্থাপিত সকল প্রশ্ন ও অভিযোগের জবাব গত ২১ বছর ধরে দিচ্ছি, কিন্তু সরকারিভাবে এসব মোকাবেলার কার্যকর কোন পদক্ষেপ এখনও দেখছি না।
বিচারের পদ্ধতি, জটিলতা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে গত চার বছরেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধারণা স্বচ্ছ হয়নি। এখনও বিচার কার্যক্রম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এবং বার বার হোঁচট খাচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে সরকার পক্ষে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ আইনজীবীর অভাবের কথা বার বার বলা হলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এর প্রতি কর্ণপাত করছেন না। যার ফলে এখন এ্যাটর্নি জেনারেলকে এনে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের টেলিফোন সংলাপ চুরি করে রেকর্ড করা এবং বাইরে পাচার ও প্রকাশ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে। তুরস্ক থেকে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসা মুসলিম ব্রাদারহুডের ১৪ জন আইনজীবী কীভাবে পেছনের দরজা দিয়ে ট্রাইব্যুনালে ঢুকলেন, কীভাবে প্রধান আসামিসহ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী, আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বললেন এ নিয়ে কোন তদন্ত হচ্ছে বলে শোনা যায়নি।



(বাকি অংশ আগামীকাল)

No comments

Powered by Blogger.