আন্দোলন যখন প্রতিষ্ঠান by মুনতাসীর মামুন

আন্দোলনে থাকলে সময়ের পরিমাপ করা যায় না। যুদ্ধাপরাধ বিচারে আমরা কতদিন ধরে জড়িত? হিসেব করে দেখিনি। আজ ১৯ জানুয়ারি, হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখি চার দশক পেরিয়ে গেছে।
১৯৭২ সাল থেকে শুরু করা আন্দোলন যে সব সময় একই গতিতে চলেছে তা নয়; জোয়ার-ভাটার মতো কখনও কূল প্লাবিত করেছে, কখনও বা ঢেউ মরে গেছে। এই আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল এই আন্দোলনে জড়ো হয়েছেন, সরে গেছেন; নতুনরা এসেছেন, সরে গেছেন; কিন্তু আন্দোলন চালু রয়েছে। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এই আন্দোলনে মানুষের সায় ছিল। সাড়া সব সময় সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না, কিন্তু সায় সব সময় থাকতে পারে। সাধারণ মানুষ যে দলই করুক না কেন, রাজাকার-আলবদরদের বিচার হবে না– এটি তারা মন থেকে মানতে পারেনি। বোধ আছে দেখে মানুষ, মানুষ। একেবারে বোধহীন হওয়াটা কষ্টকর। যারা বোধহীন, যেমন জামায়াতী বা বিএনপি তারা সাময়িক কিছু লাভ করতে পারে বটে, কিন্তু অন্তিমে তাদের হটে যেতে হয়। চেঙ্গিস খানের শাসন, হিটলারদের শাসন, ইয়াহিয়া খানদের শাসন, জিয়াউর রহমানদের শাসন অনন্তকাল চললে সভ্যতা আর এগোতো না।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রথমে দাবি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরাই। জহির রায়হান বেসরকারীভাবে তদন্ত শুরু করেছিলেন। প্রধানত বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আলবদরদের খোঁজ করে শাস্তির জন্যই তদন্ত শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে, দালালদের বিচারের দাবিও উঠছিল। সরকারের এতে নিশ্চুপ থাকার অবস্থা ছিল না। যে কারণে দালাল আইন করে বিচার শুরু হয় এবং তখন সব অপরাধই দালাল আইনের অন্তর্গত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আরেকটি আইন করেছিলেন, যা আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার আইন হিসেবে পরিচিত। আন্দোলনও ধীরে ব্যাপ্তি পায়। জামায়াতে ইসলামী কাঠগড়ায় দাঁড়ায় এবং ক্রমে তা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায়, যাকে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নামেও অভিহিত করি। মিলিটারি যেমন ক্রমে পরিচিত মেলেটারি হিসেবে। গোলাম আযমের রেজাকার তেমন পরিচিত আমাদের কাছে রাজাকার হিসেবে।
রাজাকার বিচার আন্দোলন যখন নিম্নমুখী তখন নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠা হয়। রাজাকার-বন্ধু জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময় আন্দোলন করা দুরূহ ছিল। কারণ, সিভিল সমাজের নেতৃস্থানীয় অনেকে ভাবতেন, সিভিলিয়ানদের থেকে তারা উত্তম। তবুও, যুদ্ধাপরাধীদের ইস্যুতে তারা একমত হয়েছিলেন। নির্মূল কমিটির কৃতিত্ব এই যে, এই ইস্যুতে তারা অনেককে একত্রিত করতে পেরেছিলেন, বিশেষ করে সংস্কৃতিসেবীদের। বাংলাদেশে এমন কোন নামী সাহিত্যিক, শিল্পী ছিলেন না যিনি কোন না কোন সময় এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ বিষয়টিও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে সমস্ত গণআন্দোলনের সূত্রপাত সংস্কৃতিসেবীরাই করেছেন; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনও। আর এ আন্দোলনকেও গণআন্দোলন বলতে আমার দ্বিধা নেই। গণআন্দোলন না হলে আওয়ামী লীগ ও জোট যুদ্ধাপরাধ বিচারে একমত হতো না।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, আন্দোলন কি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে? অধিকাংশের উত্তর হবেÑ না; কারণ, কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে আন্দোলন হয়। তা স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে, স্বল্পস্থায়ীও হতে পারে। লক্ষ্যে না পৌঁছলে, রাজনৈতিক দল যুক্ত থাকলে তা দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। যেমন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন। কিন্তু সিভিল সমাজ-উদ্ভূত আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার উদাহরণ খুব কম। ব্যতিক্রম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন। এর কারণ, নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া ব্যতিক্রম। আর এই ব্যতিক্রমী কাজটি হয়েছিল দেখে নির্মূল কমিটি এতদিন কাজ করে আসতে পেরেছে এবং মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে।
সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির ও জাহানারা ইমামের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। প্রথম সভায় আমরা কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম। পরে সবার সম্মতি নিয়ে ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য ছিল, বাংলাদেশের পরিচিত বিশিষ্টজনরা সবাই এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন; যেমন– সুফিয়া কামাল, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, নীলিমা ইব্রাহিম, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদÑ কে নন? অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন এর উপদেষ্টাম-লীর সভাপতি।
নির্মূল কমিটির প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। আমরা তখন থেকে অনুধাবন করেছিলাম বিচার হতে হলে রাজনৈতিক দলের সমর্থন জরুরী। সে জন্য কিছুদিনের মধ্যেই ৭২টি সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। জাহানারা ইমাম হন আহ্বায়ক। সংক্ষেপে এই কমিটি সমন্বয় কমিটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নির্মূল কমিটি তখন আর আলাদাভাবে কাজ করেনি। সমন্বয় কমিটির কাজ পরিচালনার জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জাসদের প্রয়াত কাজী আরেফ আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির নুরুল ইসলাম নাহিদ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চের’ পক্ষে আহাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, নির্মূল কমিটির পক্ষে সৈয়দ হাসান ইমাম ও শাহরিয়ার কবির। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭২ সালের দু’দশক পর ফের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল। তবে এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের কথা বলতে হয়। এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নিয়েছিলেন কাজী নূরুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবির। এই কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ। এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। এই গ্রন্থটি সারাদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এখন পর্যন্ত ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে এই গ্রন্থটি ব্যবহৃত হয়। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করলে কেন্দ্রের কর্মকা-ের ধারাবাহিকতায় নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।
নির্মূল সমন্বয় কমিটির বড় অবদান ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুটি গণতদন্ত কমিশন গঠন ও রিপোর্ট প্রকাশ এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের বিচার। এ ধরনের উদ্যোগ দেশে এই প্রথম। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করেছিল। এই মামলা নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে পরলোকগমন করেন। আর বিএনপি নিজেকে যুক্ত করেছিল পাকিস্তানমনা দল হিসেবে।
জাহানারা ইমামের আকস্মিক মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে খানিকটা ভাটা পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুলের উদ্যোগে নির্মূল কমিটির কার্যক্রম বেগবান হয়েছে। শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন এর সভাপতি ছিলেন। আমরাও অনেকে কমিটিতে ছিলাম এবং আছি। তবে শাহরিয়ার ও মুকুলই এখনও নির্মূল কমিটির প্রাণশক্তি। দু’জন দু’জনের পরিপূরকও। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর অবদানের কথাও মনে রাখার মতো।
১৯৮৫ থেকে নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। ঘাতকদের বিচার অনুষ্ঠান একটি পর্যায় বটে; কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অক্ষুণœ রাখা, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এ কারণে নির্মূল কমিটির দু’টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়। এর একটি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র ট্রাস্ট’ অন্যটি হলো ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন,’ (২০০১)। ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত আছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, শিল্পী হাশেম খান প্রমুখ। এর প্রধান সমন্বয়কারী কাজী মুকুল। প্রধানত তাঁর চেষ্টায় সারাদেশে ৭০টি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। মৌলবাদ/ জঙ্গীবাদবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাই পাঠাগারের মূল উদ্দেশ্য। চারদলীয় জোট সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ২০টি পাঠাগারের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ মেলাও প্রথম শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিই। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন।
দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলন বা ‘সাউথ এশিয়ান পিপলস ইউনিয়ন এগেইনস্ট ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড কমিউনিজম’ ২০০১ সালে ঢাকায় দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। বিষয় ছিল, ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড কমিউনিজম : রোল অব সিভিল সোসাইটি। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে জি এ সাংমা, হামজা আলাভী, দামান দুঙ্গানা, এম. জে আকবর, আইকে গুজরাল, সুনীল উইজেসি সার্ধানায় প্রমুখ যোগ দেন। বছর কয়েক আগে এর উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ‘পিস জাস্টিস অ্যান্ড সিকিউলার হিউম্যানিজম’। এবার জার্মানি, সুইডেন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, রাশিয়া এবং পাকিস্তান থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা এক বাক্যে ‘ঢাকা ঘোষণায়’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমর্থন করে গেছেন।
না, এখানেই শেষ নয়। সারা বছর নির্মূল কমিটি ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে সভা-সমিতি, সেমিনার করেছে যার সংখ্যা হাজারের ওপর। যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, সংবিধান বিষয়ে ১২০টি পুস্তিকা/গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এ রেকর্ড আর কোন বেসরকারী সংস্থার আছে কী না সন্দেহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জোট সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল তার ওপর তিন খ-ে ৩০০০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ। নাম– ‘শ্বেতপত্র– বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন’। যুদ্ধাপরাধী আইনের ওপরও কয়েকটি পুস্তিকা উল্লেখযোগ্য।
নির্মূল কমিটির উদ্যোগে শাহরিয়ার কবির চার ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন যা দেশে-বিদেশে আদৃত হয়েছে। এগুলো হলো : সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওপর ‘আমাদের বাঁচতে দাও’, ‘যুদ্ধাপরাধ ৭১’ ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ এবং ‘পোট্রেট অব জিহাদ’। বীরাঙ্গনাদের নির্মূল কমিটিই প্রথম সম্মাননা জানিয়েছে। এরপর বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিতে অন্যান্য সংস্থা এগিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিভিন্ন জায়গায় নির্মূল কমিটি ত্রাণ পরিচালনা করেছে। এখনও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে নির্মূল কমিটি দেশের দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা/বীরাঙ্গনাদের নিয়মিত সাহায্য করেছে। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে একটি ডাটা ব্যাংক গড়ে তুলেছে। ঊৎৎড়ৎ! ঐুঢ়বৎষরহশ ৎবভবৎবহপব হড়ঃ াধষরফ. ইধহমষধফবংয.ড়ৎম নামে একটি ওয়েবসাইটও আছে।
১৯৯৫ সাল থেকে নির্মূল কমিটি জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছে। এ বক্তৃতা দিয়েছেন কবীর চৌধুরী, কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান, কে এম সোবহান প্রমুখ। এ পর্যন্ত ১২টি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে। সম্প্রতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী পরলোকগমন করলে তাঁর স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করা হয়েছিল কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা যা প্রদান করেছেন জনাব এএমএ মুহিত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে নির্মূল কমিটি ১টি প্রতিষ্ঠান ও একজন ব্যক্তিকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ প্রদান করে। এ পর্যন্ত ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পদক দিয়ে আসছে সম্মানিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছেনÑপ্রয়াত সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, শওকত আলী খান প্রমুখ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, টোয়েন্টি টোয়েন্টি টেলিভিশন (লন্ডন), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সময় প্রকাশন প্রভৃতি। যুদ্ধাপরাধ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ নিয়ে অনেক পোস্টার এবং লিফলেট প্রকাশ করেছে কমিটি।
নির্মূল কমিটির শাখার সংখ্যা এখন ২০০। বিদেশে ১২। সে হিসেবে বলা যায়, সিভিল সমাজের সবচেয়ে বড় সংগঠন নির্মূল কমিটি। জাতীয় হিসাবে ধরলে চারটি বড় রাজনৈতিক দলের পরই নির্মূল কমিটির অবস্থান।
গত দুই দশক থেকে, আগেই বলেছি, বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা এর সঙ্গে জড়িত। এই সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য দিতে কোন প্রতিষ্ঠান বা ধনীরা সবসময়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। কমিটির শুভানুধ্যায়ী ও সদস্যদের চাঁদায় সংগঠন চলছে যা খুবই কষ্টকর। একমাত্র প্রয়াত শিল্পী নিতুন কু-ু জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদকের ক্রেস্ট নিয়মিত তৈরি করে দিয়েছেন। স্থপতি, কবি রবিউল হোসাইন এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, এ দেশে পাকিস্তানের এজেন্ট প্রাক্তন দু’জন রাষ্ট্রপতি এলিট সমাজকে ভালভাবে বিভক্ত করতে পেরেছেন। তারা বোঝাতে পেরেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে আন্দোলন কোন সুস্থ চাওয়ার বিষয় নয়, এটি রাজনীতি। ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় প্রকাশিত বলে অনুমিত (এ বিষয়ে কখনও কোন প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে না। উইকিলিকস যদি কখনও পারে) ‘র ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বইয়ে নির্মূল কমিটিকে র-এর এজেন্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের ঘাঁটি যে কত শক্ত এটি তার প্রমাণ। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের পক্ষে নির্মূল কমিটি বিভিন্ন জায়গায় (বিশেষ করে যেখানে যুদ্ধাপরাধীরা দাঁড়িয়েছিল) সভা করে জনমত সংগঠন করেছিল।
এই সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেয়ার একটা কারণ আছে। নির্মূল কমিটির অনেক কর্মকা-ের কথা আমারও মনে নেই। আজ মুক্তিযুদ্ধের যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে তাতে অনেক ব্যক্তি, সংস্থার অবদান স্বীকার করেও বলতে হয়, এতে নির্মূল কমিটির অবদান বেশি। কারণ এক্ষেত্রে এত বেশি কাজ কেউ করেনি। অনেকের কাজ মার্চ বা ডিসেম্বরে সীমাবদ্ধ। নির্মূল কমিটির কাজ চলে সারা বছর। আমরা অনেকে শুরু থেকে ছিলাম নির্মূল কমিটির সঙ্গে, এখনও আছি অনেকে, তবে নির্মূল কমিটির এই যে আন্দোলন তা এখনও সজীব; তার কারণ এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এ কারণেই এটি আলোচনার বিষয় যে, যা পারিনি তা করা যেতে পারে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়। আর নির্মূল কমিটির এই কৃতিত্বের জন্য আমরা সবাই দাবিদার হতে পারি, কিন্তু আমি মনে করি শাহরিয়ার কবিরের উদ্যম ও কাজী মুকুলের সাংগঠনিক শক্তি না থাকলে আজ নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো না। জোট আমলে মন্ত্রী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ব্যক্তিগত আক্রোশে শাহরিয়ারকে চাকরিচ্যুত করে। সে থেকে আর তিনি কোন চাকরি পাননি, করেনওনি। সারাটা সময় খালি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। শাহরিয়ারের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য হয়। অনেকে আমরা তাকে অপছন্দ করি। পছন্দও করি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বাস্তবায়নে তাঁর অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমি তো মনে করি, ‘স্বাধীনতা পদক’ পাওয়ার অন্যতম দাবিদার তিনি।
আজ কুড়ি বছর পর মনে হচ্ছে, খুব কম দেশে এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা। কবি শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রবীণ শওকত ওসমানকে যখন ডেকেছি তখনই সাড়া দিয়েছেন। হাশেম খান বা রফিকুন নবীর কাছে যখন পোস্টার চেয়েছি নির্দ্বিধায় করে দিয়েছেন। বিচারপতি কে.এম. সোবহান তো আমাদের বয়সীই হয়ে গিয়েছিলেন। মনে পড়ছে ব্যারিস্টার শওকত আলীর কথাও, সব সময় যিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। বক্তা হিসেবে কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কখনই বিমুখ করেননি। কবীর চৌধুরী ও নির্মূল কমিটি তো একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। কলিম শরাফীর কথাও বা কীভাবে ভুলি! শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বা সালমা চৌধুরীকে আজ পর্যন্ত দেখিনি একটি সভা বা মিছিলে অনুপস্থিত থাকতে। এভাবে সবাই মিলে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। অনেকেই আন্দোলন করেছেন। কিন্তু নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য হলো এ আন্দোলনের পথ থেকে সরে না যাওয়া, বিরতি না দেওয়া। এটিই নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয়, এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার আইন, ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্মূল কমিটিই নিরন্তর বলে যাচ্ছে, দাবি তুলছে এবং তুলে যাবে যতদিন রায় কার্যকর না হবে। আর যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর হলেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে না; জামায়াত-বিএনপির কারণে যে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে তার বিরুদ্ধেও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
নির্মূল কমিটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কারণ হলো, আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমেই এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গীবাদ বিলুপ্ত হবে না। যুদ্ধাপরাধ বিচার মুক্তিযুদ্ধের একটা পর্যায় মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের বাকি লক্ষ্যগুলো অর্জন দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের ব্যাপার। আমরা যদি না থাকি তাহলে আমাদের উত্তরসূরিরা যাতে এ আন্দোলনটি সজীব রাখতে পারে সে জন্যই এত পরিশ্রম। আমরা বলতে পারি গর্ব করে, অনেক কিছু না পারলেও কিছু কাজ তো করতে পেরেছি।

No comments

Powered by Blogger.