ব্ল্যাকআউট সম্পর্কে একজন পরিকল্পনাবিদ- বিদ্যুত বিপর্যয় by মোয়াজ্জেম হোসেন

আবুধাবির ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান। এর আগে দুবাই ইলেকট্রিসিটির ট্রান্সমিশনে তিনি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। সততা এবং কর্মদতা তাঁকে এত দূর নিয়ে এসেছে।
গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিনারঞ্জি কনফারেন্স এ্যান্ড এক্সিবিশন এশিয়া প্যাসিফিক _এর উদ্যোগে ব্যাংককে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়ে গেল। ইমপেরিয়াল কুইনস পার্ক হোটেলে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে তিনি ইলেকট্রিসিটি ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন স্মার্ট গ্রিডের ওপর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিন দিনব্যাপী এ সেমিনারে তিন প্রবন্ধ উপস্থাপক, স্লাইড প্রদর্শকসহ বিশ্বের চলি্লশটি দেশের একশ পঞ্চাশ প্রতিনিধি যোগ দেন। ইলেকট্রিসিটি নেটওয়ার্কে ব্ল্যাকআউটের কারণ, প্রতিকার নিয়ে তাঁর এ প্রবন্ধ। নিরাপত্তা, নির্ভরতা এবং গুণগত বিদু্যত সরবরাহ বিভাগে লেখাটি অন্তভর্ুক্ত হয়।
পরিকল্পনাবিদ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা বলেন নিমাই সরকার। ব্যাংককে উপস্থাপিত প্রবন্ধ এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের আলোকে এ সাাতকার।]
নিমাই সরকার : বিদু্যত বিপর্যয়ে ব্ল্যাকআউট নিয়ে কথা হয়। আসলে বিষয়টা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন আপনি?
মোয়াজ্জেম হোসেন : ব্ল্যাকআউট সম্পর্কে মুক্ত বিশ্ব বীায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনাক্রমে বিদু্যত শক্তি হারানো। বিশ্ব বীায় আরও একটি অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে। আর তা হলো আন্তর্জাতিক বিদু্যত ঘাটতি। তাহলে বিদু্যতের কারণে ব্যাপক অঞ্চলের মানুষ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হলে সেই অবস্থাকে ব্ল্যাক আউট দিয়ে বুঝানো যেতে পারে। বিষয়টি অবশ্যই অনাকাঙ্তি এবং দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে।
এর বাইরে যুদ্ধকালে কোন অঞ্চল, বিশেষ স্পর্শকাতর জায়গা, আকাশপথে শত্রুপরে আক্রমণ থেকে রা করার জন্য ব্ল্যাকআউট বা নি্#৬৩৭৪৩;্রদীপের আওতায় নেয়া হয়। এেেত্র বিষয়টি পরিকল্পিত।
নিমাই সরকার : আন্তর্জাতিক বিদু্যত ঘাটতি বলতে কী বুঝতে পারি আমরা?
মোয়াজ্জেম হোসেন : বিদু্যত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, ল ল মানুষ অন্ধকারে হাতড়ে মরবে তা অবশ্যই অনাকাঙ্তি। তবে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটেছে। আর এমনটি যদি দুইটি দেশের েেত্র একই সঙ্গে ঘটে তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক বিদু্যত ঘাটতি বলা যায় নিঃসন্দেহে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার বিদু্যত বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করা যায়।
২০০৯ সালের ১৪ আগস্ট। ৩০ মিনিট স্থায়ী হয় বিদু্যতবিহীন এ অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের চারটি রাজ্যে বিদু্যত ছিল না। নিউইয়র্ক থেকে ডেট্রয়েট, টরন্টো থেকে ওটাওয়া পর্যন্ত অন্ধকারে ডুবে যায়। দুই দেশের ৫০ মিলিয়ন মানুষ এই ব্ল্যাকআউটের শিকার। ৯টি নিউকিয়ার রিএ্যাক্টর বন্ধ হয়ে যায়। জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরসহ নিউইয়র্ক এবং কানাডার ৬টি বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। তাহলে এই সমস্যাকে কি বলব, শুধু একটি অঞ্চলের সমস্যা কিংবা এই বিদু্যত ঘাটতি শুধুই একটি দেশের!
নিমাই সরকার : এই ধরনের ব্ল্যাকআউট কেন হয়?
মোয়াজ্জেম হোসেন : পাওয়ার সিস্টেমে ভারসাম্য ধরে রাখার একটা ব্যাপার আছে। সিস্টেম ভারসাম্যহীনতার কারণে ব্ল্যাকআউটের দিকে ধাবিত হতে পারে।
সিস্টেমের একটি নেটওয়ার্কে আছে জেনারেটর। বিদু্যত উৎপাদনের পর বিদু্যত শক্তিকে উচ্চ ভোল্টেজে চড়িয়ে দেয়া হয় সঞ্চালন বা গ্রিড লাইনে। টাওয়ারের উপর দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নেওয়া হয় সে পাওয়ার। তারপর গ্রিড স্টেশনে নামিয়ে ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে মধ্যম ভোল্টেজে পরিবর্তন করে পাঠানো হয় প্রাইমারি সাব স্টেশনে। পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে শুরুতে উচ্চ ভোল্টেজে বিদু্যত শক্তি পাঠানোর সময়ও ট্রান্সফরমারের আশ্রয় নেয়া হয়। জেনারেটর, সঞ্চালন লাইন কিংবা ট্রান্সফরমার যাই বলি না কেন, এর প্রত্যেকটি ইকুইপমেন্ট প্রতিনিয়ত একটি ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে সক্রিয় থাকে।
আন্ডারলোড, ওভারলোড সব কারণেই জেনারেটর অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। শুধু জেনারেটর কেন, সঞ্চালন লাইন, ট্রান্সফরমার_ এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বাসবার বা ফিডারের বেলায়ও কথাটি প্রযোজ্য।
আর একটি কথা এেেত্র বলে নিতে হয়। একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বা বিদু্যত কেন্দ্র থেকে টাওয়ারের উপর দিয়ে একটি সার্কিট যায় না কেবল। আবার অনেক বিদু্যত কেন্দ্র থেকে অনেক অনেক সার্কিট যুক্ত হয় জাতীয় বা মেইন গ্রিড লাইনে।
এখন ধরা যাক, একটি সার্কিট কোনভাবে ট্রিপ করল বা বন্ধ হয়ে গেল। অন্য সার্কিটের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। এবার আর একটি সার্কিট বন্ধ হলো। সেইভাবে আর একটি । এইভাবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য উদ্যোগ নেয়ার পরও যদি একটির পর একটি সার্কিট বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এর পরিণতি ব্ল্যাকআউটে রূপ নেয়।
নিমাই সরকার : ব্ল্যাকআউটে প্রকৃতির প্রভাব কতটুকু?
মোয়াজ্জেম হোসেন : বাজে আবহাওয়া, ঝড়-ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিবায়ুতে কোন টাওয়ার ভেঙ্গে পড়লে সার্কিটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে সঞ্চালন লাইনের উপর গাছগাছালি পড়লে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে গোটা সার্কিট। আকাশে বিদু্যত চমকালে সঞ্চালন বিকল হয়ে পড়বে। দৃষ্টান্ত অনেক। টাওয়ার ভেঙ্গে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চল ব্ল্যাকআউটের শিকার হয়। নিউইয়র্ক তলিয়ে যায় অন্ধকার বিদু্যত চমকানির অনিবার্য পরিণতিতে। একই ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আর একটি রাজ্যে সঞ্চালন লাইনে অগি্ন স্ফুলিঙ্গের পরপরই ডুবে যায় অন্ধকারে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় ব্ল্যাকআউট সংঘটিত হয়েছিল সঞ্চালন লাইনে বৃ উপড়ে পড়ে। এর এক মাস পর ইতালিতে ঘটে একই ঘটনা এবং একই কারণে।
নিমাই সরকার : ব্ল্যাকআউট পরিহারে করণীয় কী আন্তর্জাতিক কিংবা বাংলাদেশের প্রোপটে?
মোয়াজ্জেম হোসেন : পাওয়ার সিস্টেমে কন্ট্রোল সেন্টারের অপারেশন ইঞ্জিনিয়াররা বিদু্যত প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেন। লোডের ভারসাম্য রা করা তাদের কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোনভাবে সিস্টেম ভেঙ্গে পড়তে পারবে না। সিস্টেমের একটি অংশে অস্বাভাবিক কিছু হলে ৩০ মিনিটের মধ্যে জেনারেটর বা অন্য অংশ থেকে সপ্লিাই আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অংশে লোডশেডিংও দেয়া লাগতে পারে। তবে দেখতে হবে, ওই এলাকার গ্রাহকদের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কিনা! অর্থাৎ অপরিকল্পিতভাবে কোন ব্ল্যাকআউটে চলে না যায়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
অপারেশন ইঞ্জিনিয়ারকে সহায়তা দানের জন্য আছে কম্পিউটার সিস্টেম। সঞ্চালনে বা জেনারেশনে কোন সমস্যা দেখা দিলে এ্যালার্ম -এর মাধ্যমে তাঁরা সঙ্কেত পান এর মধ্যদিয়ে বিদু্যত প্রবাহের ধরন বোঝা যায়। সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ার কোন আশঙ্কা থাকলে তাঁরা তা টের পান। এর ভিত্তিতে তাঁরা জেনারেশনেও পরিবর্তন আনতে পারেন। যদি কম্পিউটার সিস্টেম সহায়তা করায় ব্যর্থ হয় তাহলে অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার গ্রিড সিস্টেমকে সরাসরি পর্যবেণে রাখবেন। এ েেত্র তারা সম্ভাব্য অপারেশন প্যাটার্ন অনুসরণ করে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন। এ গেল স্থানীয় কন্ট্রোল সেন্টারের কথা। এ ছাড়া একটি আঞ্চলিক কন্ট্রোল সেন্টার থাকে। সেটাই কতকগুলো স্থানীয় কন্ট্রোল সেন্টারকে সমন্বয় করে থাকে।
তবে এ কন্ট্রোল সেন্টারের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই জন্যই চাই লাগসই পরিকল্পনা। পরিকল্পনামাফিক কাজ করার জন্য আবার প্রয়োজন ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিণ। প্রশিণ ছাড়া পরিকল্পনাকে কখনও কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রোপট কারিগরি করণীয়তে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা নয় । কন্ট্রোল সেন্টারের কাজগুলোর প্রকৃতি একই রকমের।
এ েেত্র একটি বিষয় কেবল উল্লেখ করব_ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড থেকে সাবধান থাকতে হবে। আত্মঘাতী কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে নজর রাখা আবশ্যক।
মোয়াজ্জেম হোসেন। আবুধাবির বাঙালী পাড়ায় গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত একটি নাম। এর কারণ হতে পারে দুবাই ইলেকট্রিসিটিতে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগে যথেষ্ট অবদান রয়েছে তাঁর। সেই ধারা অব্যাহত আবুধাবি ডিস্ট্রিবিশনেও।
বাংলাদেশের কৃষিেেত্র সোলার এনার্জি প্রয়োগে তাঁর প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। তাইওয়ান ও ভারতের এনার্জিবিষয়ক কোম্পানির সঙ্গে তিনি এ নিয়ে মতবিনিময় অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি তিনি তাইওয়ান ঘুরে এলেন সেই দেশের একটি সোলার কোম্পানি সঙ্গে আলোচনা করে। তার স্বপ্ন সফল হবে_ এই আশা।

No comments

Powered by Blogger.