জ্বরজনিত খিচুনি

মনে হলো যেন আপনার বাচ্চা এবার একেবারেই শেষ। তার চোখ উল্টানো, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু খুবই কম। মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে, নীল হয়ে যচ্ছে। গায়ে অনেক জ্বর। বাড়ির সবাই হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করছে।
বালতি বালতি পানি এনে ঢেলে দিচ্ছে গায়ে, যেন বাচ্চা এখনই শেষ। সে অজ্ঞান। তার ৫ মিনিট পর হয়ত সে স্বাভাবিক। চোখ উল্টানো কমে স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছে। আসলে উপরের সে চিত্রটি দেখলেন তা একটি 'জ্বরজনিত খিচুনি'র একেবারেই কমন চিত্র।
০ একদিনের বা দু'দিনের জ্বর। জ্বর যখন একেবারে পিক-এ তখন স্বভাবতই খিচুনি হয়।
০ জ্বরজনিত খিচুনির বয়সটা ৬ মাস থকে ৬ বছর পর্যনত্ম বাচ্চাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ
০ শতকরা তিনটি শিশুর ৰেত্রে জ্বরজনিত খিচুনি হয়।
আপনার আগের বাচ্চার ৰেত্রে খিচুনি হলে পরের বাচ্চার ৰেত্রে খিচুনির আশঙ্কা বেশি থাকে। বাবা বা মায়ের খিচুনির ইতিহাস থাকলে বাচ্চার ৰেত্রে তা বেশি হয়।
০ গলার প্রদাহ বা শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহে সবচেয়ে বেশি খিচুনি হয়। তবে পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়ে জ্বর হলে খিচুনি হতে পারে। তবে মনে রাখবেন, অবশ্যই মসত্মিষ্কে প্রদাহ থাকলে তাকে জ্বরজনিত খিচুনি বলা যাবে না। তাকে তখন আমরা মেনিনজাইটিস বা ইনকেফালাইটিস বলব। এ এক ধরনের মারাত্মক প্রদাহ। সেখানে ঘাড় শক্ত হবে কিংবা মাথার তালু উঁচু হয় যাবে। চোখ মেলে আলোর দিকে চাইতে পারবে না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে। সে ৰেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করতে হবে (১৪ থেকে ২১ দিন পর্যনত্ম লাগতে পারে)।
ঙ্ জ্বরজনিত খিচুনি মারাত্মক কিছু নয়। এতে বাচ্চার স্বাভাবিক গড়ন ও গঠনে কোন ৰতি হয় না। একটা বয়সের পর জ্বর হলেও আর খিচুনি হবে না।
ঙ্ একবারের জ্বরে স্বাভাবতই একবারই খিচুনি হয়। তবে ২ বা ৩ বারও হতে পারে ১৫% ৰেত্রে।
ঙ্ খিচুনির পর আর কোন খিচুনির প্রভাব শরীরে থাকে না।
ঙ্ খিচুনি সাধারণত ৩ থেকে ৫ মিনিট পর্যনত্ম স্থায়ী হয়। তবে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট পর্যনত্ম খিচুনি হতে পারে। ১৫ মিনিটের বেশি খিচুনিকে আমরা অস্বাভাবিক বলব। স্বাভাবিকভাবে জ্বরজনিত খিচুনিতে দেহের সমসত্ম অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ জড়িত থাকে। যদি একটি অঙ্গ বা এক পাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত থাকে তবে সে ৰেত্রে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
কী করবেন জ্বরজনিত খিচুনি হলে?
-বাচ্চাকে কাত করে শুইয়ে দিন।
_ লালা পরিষ্কার করম্নন যেন তা শ্বাসনালীর পথ রম্নদ্ধ না করে। বাল্ব সাকার ব্যবহার করতে পারেন এৰেত্রে।
_কুসুম গরম পানি দিয়ে গা-হাত-পা মাথা মুছিয়ে দিন।
_মলদ্বারে একটি প্যারাসিটামল সাপোজিটরি (১২৫ মি.গ্রা. বা ২৫০ মি.গ্রা.) ঢুকিয়ে দিন। (সারা বছর ফ্রিজে রাখতে পারেন)
_একটি ডায়াজিপাম সাপোজিটরি (.৫ মি.গ্রা. প্রতিকেজি) মলদ্বারে ঢুিকয়ে দিন (ফ্রিজে রেখে দিন সারাবছর)।
_তারপর পার্শ্ববতর্ী হাসপাতাল বা কিনিকে নিয়ে যান বা ডাক্তার দেখান।
একবার জ্বরজনিত খিচুনি হলে পরবতর্ীতে যাতে আর খিচুনি না হয় সে ৰেত্রে মায়েদের দায়িত্ব :
_আপনার বচ্চার ৬ বছর বয়স পর্যনত্ম জ্বর হলেই খিচুনি হতে পারে।
_জ্বর হলেই বাচ্চাকে প্রয়োজনমতো (১৫ মি.গ্রা. প্রতি ডোজ) প্যারাসিটামল সকাল-দুপুর-বিকাল-রাত্রি ৬ ঘণ্টা অনত্মর খেতে দিন।
-ট্যাবলেট ডায়াজিপাম গুঁড়ো করে গুলে তিন বার খেতে দিন (.৩ মি.গ্রা. প্রতিকেজি) তার পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
তবে এ কথা সত্যি, বাচ্চার বয়স যদি ৬ মাসের নিচে হয় কিংবা ৬ বছরের বেশি হয়, যদি ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে খিচুনি হয় তাহলে সতর্ক হতে হবে। যদি খিচুনির পর শরীরে অবশ ভাব থাকে তাহলে সতর্ক হতে হবে। যদি শরীরের এক পাশেই খিচুনি হয় তাহলেও সতর্ক হতে হবে।
জ্বরবিহীন খিচুনিও উদ্বেগের বিষয়।
পরিশেষে, জ্বরজনিত খিচুনিতে অতটা ভয় না পেয়ে যদি একটু সতর্ক থাকেন তবে আপনি বাসায় আপনার বাচ্চার খিচুনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং অযথা বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারেন। ভয় নেই, আপনার বাচ্চা পরবতর্ীতে সুস্থ-সবল আর সব বাচ্চার মতো গড়ে উঠবে। আপানি অযথা চিনত্মা করবেন না যে, পরবতর্ীতে আপনার বাচ্চার মৃগী রোগ হবে। সেৰেত্রে আশঙ্কা জ্বরজনিত খিচুনি রোগের বাচ্চাদের ৰেত্রে শতকরা মাত্র ২ থেকে ৪ জন। স্বাভাবিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামগ্রিক মৃগী রোগও প্রায় শতকরা ২ জনের। সুতরাং জ্বরজনিত খিচুনির সঙ্গে মৃগী রোগের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায়।
ড. এটিএম রফিক উজ্জ্বল
রেজি: শিশু বিভাগ, হলিফ্যামিলি হাসপাতাল

No comments

Powered by Blogger.