তলাবিহীন ঝুড়ি নয়- বাংলাদেশকে একদিন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল সেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ

বন্যা, দুর্ভিক্ষ আর ঝড়ঝঞ্ঝার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক সময় বহির্বিশে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় পরিচিত ছিল। এ ধরনের ধারণার পেছনে বাস্তব অবস্থা যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্যমাখা করুণাবোধ।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বটমলেস বাসকেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে। তার এই ব্যঙ্গোক্তির মধ্যে ছিল সদ্যস্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের প্রতি চরম অবহেলা আর তিামাশা। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। বিগত একচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ নানা সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেই তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন ভরপুর খাদ্যঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতির বিবরণ ছাপা হচ্ছে বিশ্বের বিখ্যাতসব পত্রিকায়। নানা স্বীকৃতমানের জরিপে উঠে আসছে সেসব তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান। আর তাই তো সেই কিসিঞ্জারের দেশেরই আরেক কূটনীতিকÑ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের বৈপ্লবিক সাফল্য সম্পর্কে। তিনি বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্যবিপ্লবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সে বিপ্লবে জয়ী হতে চলেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনার এই সচেতন স্বীকারোক্তি ও সপ্রশংস বক্তব্য নিছক প্রথামাফিক কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়; বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অগ্রসর অবস্থার প্রেক্ষাপটে এটি তাঁর বাস্তবানুগ বিশ্লেষণ। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্য-প্রযুক্তি, বিদ্যুত ইত্যাদি খাতে বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন এখন বিশ্বপ্রেক্ষাপটে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। যে বাংলাদেশকে একদিন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল সেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, সময়মতো সার, বীজ ও উপকরণ সরবরাহ এবং কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমÑ এই বহুমুখী ব্যবস্থার মেলবন্ধনের ফলেই এই সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানা সামাজিক কর্মসূচী: টিআর, কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি চালু রয়েছে গ্রামাঞ্চলে; যা প্রান্তিক মানুষের অবস্থার উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি স্বীকার করতেই হবে যে, এখনও দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ এখনও অতিদরিদ্র। সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করছে। তার ফলও সন্তোষজনক; কিন্তু সর্বমোট জনসংখ্যার অনুপাতের হিসাবে তা এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তবে বিগত একচল্লিশ বছরে শতপ্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে দেশ যেভাবে নানা সূচকে অগ্রগতি অর্জন করেছে তাকে আরও বেগবান করে সমন্বিতভাবে নিতে পারলে পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন সুদূরপ্রসারী নয় বলেই আশা করা যায়।
দেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়েছে বেশ আগেই। এখন তার সামনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। বিদেশীরা উন্নয়নের সার্টিফিকেট দিচ্ছে বলেই যে আমরা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলব, তা নয়; নিজেদের সার্বিক স্বার্থেই উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রতিটি সূচক উর্ধমুখী রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর যে সব ক্ষেত্রে এখনও পশ্চাৎপদতা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে যাতে রূপকল্প ২০২১-এর স্বপ্ন-প্রত্যাশা অধরা থেকে না যায়।

No comments

Powered by Blogger.