নান্দনিকতার ছোঁয়া_ পাখির কলতান তারুণ্যের উচ্ছ্বাস- এডওয়ার্ড পার্ক ফিরে পাচ্ছে হারানো জৌলুস সমুদ্র হক

পাম ট্রিগুলো মাথা উঁচু করে জানিয়ে দিচ্ছে দূর অতীতের কতই না কথা। সবুজের বেষ্টনীতে ছায়াঢাকা উদ্যানের ধূলিকণায় মিশে আছে বগুড়ার স্মৃতিময় ইতিহাস আর ঐতিহ্য। কত মনীষীর পদচারণার গৌরব বহন করে চলেছে একদার উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় উদ্যান।
জনশ্রম্নতি আছে, ঢাকার রমনা পার্কের পরই স্থান ছিল বগুড়ার এডওয়ার্ড পার্কের। এই পার্ক হারানো জৌলুস ফিরে পাচ্ছে। নিত্যদিন ভোরবেলা পাখিদের কলতানের সঙ্গে শুরম্ন হয়ে যায় কয়েক শ' নারী-পুরম্নষের মর্নিংওয়াক। ঐতিহ্যের এই পার্কের যে যৌবন হারিয়েই গিয়েছিল প্রায় নান্দনিকতার ছোঁয়ায় প্রকৃতির গাছগাছালির পরশে ফিরে আসছে। পৌর কর্তৃপ জানালেন, মানুষকে প্রকৃতির নিসর্গের মধ্যে রাখার প্রয়াসে বহুমুখী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
দিনভর এই পার্ক শিশু কিশোর তরম্নন তরম্ননী প্রৌঢ় বয়স্কদের আনাগোনায় মেতে থাকে এখন। দোলনায় উঠে শিশুরা সুর তোলেন দোল দোল দুলুনি...। আনন্দ সরোবরের চারধারে ছাতার নিচে ও কৃত্রিম উপত্যকায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা তরম্নণ তরম্নণী পাখিদের জলকেলি খেলার মতো যৌবনের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। কেউ জুটিবদ্ধ হয়ে এসে প্রণয়ের মধুময়তায় কিছুটা সময় কাটিয়ে যায়। জীবনের এই অধ্যায়ে রয়ে যায় কতই স্মৃতি। ফুলের বাগান, লতাগুল্মের তৈরি প্রকৃতির তোরণ, আম্রকুঞ্জ, নানা ধরনের গাছগাছালির মধ্যে বেড়ে যায় সাধারণের আনাগোনা। ভিড় হয় বলে বাদামওয়ালা ফুচকাওয়ালারাও আসে পার্কে। ভালই হয় বেচাকেনা। প্রতিবছর বাংলা বর্ষ বরণ উৎসব, পৌষ মেলা, পিঠা উৎসবসহ নানা আয়োজন থাকে পার্কের ধারের আম্রকুঞ্জে। প্রায় ৬০টি পামট্রি সা্য দেয় অতীতের। একটি পামট্রি দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে আছে। হানাদার পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর রকেট শেল আঘাত করে সেই পাম গাছে। শত বছরেরও বেশি সময়ের আগের এই পার্কের এক ধারে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরী অপর প্রানত্মে হাজার আসনের বড় মিলনায়তন। সংস্কৃতির বিকাশে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন কালেক্টর কুমার রামকৃষ্ণের সহযোগিতায় বগুড়ার সুধীজন ও নাট্যউদ্যমী ব্যক্তিরা শহরের গোহাইল রোডের ধারে ২৯ বিঘা ভূমির ওপর পার্ক স্থাপনের সময় একটি নাট্যশালা (মঞ্চ) স্থাপন করেন। ব্রিটিশ সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের নামে পার্ক ও নাট্যশালার নামকরণ করা হয়। এই এডওয়ার্ড মঞ্চ একসময় ছিল এ অঞ্চলের একমাত্র ঘূণর্ায়মান রঙ্গমঞ্চ। ত্রিশের দশকে এই মঞ্চেই কলকাতার ডাকসাইটে বাঘা নাট্য ব্যক্তিত্ব হেম লাহিড়ী, বর্জ মজুমদার, সুরেশ দত্ত, প্রমোদ লাহিড়ী মঞ্চ কাঁপিয়ে গেছেন। সেদিনের সেই নাট্যমঞ্চ যুগের ধারায় আধুনিকায়ন হয়ে আজকের কম্যুনিটি হল। স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের পর কৃতজ্ঞ বগুড়াবাসী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা টিটুর নামে কমিউনিটি হলের নামকরণ করে শহীদ টিটু মিলনায়তন। পার্কটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ১৯০৬ সালে কাজলার জমিদার আনন্দ চন্দ্র সেন, প্রেমানন্দ সেন, নিত্য নন্দন সেন একটি পুকুর খনন করে দেন। নাম হয় 'আনন্দ সরোবর।' পাথরে 'ফর দ্য ইউজ এ্যান্ড বেনিফিট অব পিপল...' লিখে এই সরোবর উদ্বোধন করেন তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জে এন গুপ্ত। ১৯১২ সালে আদমদীঘির জমিদার বাবু সতীশ চন্দ্র নিয়োগী একটি ফোয়ারা স্থাপন করে দেন। এই পার্কে ১৯২১ সালে আসেন মহাত্না গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৬৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এডওয়ার্ড পার্কে জনসভায় ৬ দফা দাবির বিশেস্নষন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এই পার্কেই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তিগণ তরম্নণদের ট্রেনিং দিয়েছেন। বলকান যুদ্ধের পর এডওয়ার্ড মঞ্চে বক্তব্য রাখেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ১৯২৭ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলাম এডওয়ার্ড মঞ্চে সভার পর বিদ্রোহী ও কা-ারি হুঁশিয়ার কবিতা আবৃত্তি করেন। ১৯৪৫ সালে নিখিল বঙ্গ পাটচাষী সম্মেলন, ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর কৃষক সম্মেলন হয় এই পার্কে।
বগুড়া এডওয়ার্ড পার্কের সঙ্গে মিশে আছে কত ইতিহাস। সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড নামকরনের পর গ্রেট ব্রিটেনের পরবতর্ী সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ডের কাহিনী তো কিংবদনত্মি হয়ে আছে। লেডি সিম্পসনের সঙ্গে প্রণয়ের কারণে সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করে প্রেমকেই প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসের কত কাহিনীর সা্য বহন করে চলেছে বগুড়ার এডওয়ার্ড পার্ক।

No comments

Powered by Blogger.