বিষয় বরাদ্দে মেধাক্রম অনুসরণ করা হচ্ছে না

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্নাতক প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকার ক্রম অনুসরণ না করার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ছয়টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে।
তবে বিষয় বরাদ্দ নিয়ে এ ধরনের অনিয়মের সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা গেছে। চলতি বছরের ভর্তি-প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল পদ্ধতি বাদ দেওয়া হয়েছে। চালু করা হয়েছে পুরোনো সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিষয় বরাদ্দের পদ্ধতি। এর ফলে ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম শুরু হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগসহ সরকার-সমর্থক কিছু প্রভাবশালীকে সুবিধা দিতে পুরোনো পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ ৯০ জন শিক্ষক গতকাল শুক্রবার এক যুক্ত বিবৃতিতে সাক্ষাৎকারভিত্তিক পদ্ধতিতে বিষয় বরাদ্দের কারণে ভর্তি-প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁরা অবিলম্বে পুরোনো এই পদ্ধতি বাতিল করে আগের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি জানান। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিষয় বরাদ্দ নিয়ে অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও ভর্তি-বাণিজ্যের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি করা হয়।
১৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বিষয় বরাদ্দের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী সেখানে উপস্থিত হন। তাঁরা কয়েকজন শিক্ষার্থীর ক্রমিক নম্বর দিয়ে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বরাদ্দ দিতে কলা অনুষদের ডিন আবদুল ওদুদকে চাপ দেন।
জানতে চাইলে শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষাৎকার চলাকালে বিষয় বরাদ্দের ব্যাপারে নয়জন ভর্তি-ইচ্ছুকের অভিযোগ নিয়ে ডিনের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় সাংবাদিকেরাও একই অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কেন ভর্তি-প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাতে যাব?’
ভর্তি-ইচ্ছুকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ডিন ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ছাড়া অন্য কারও ওই কক্ষে উপস্থিত থাকার নিয়ম নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কলা অনুষদের ডিন আবদুল ওদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্ষাৎকারকক্ষে বাইরের কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও সেদিন ছাত্রলীগের সভাপতি বিষয় বরাদ্দসংক্রান্ত কয়েকটি অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন। কয়েকজন সাংবাদিকও একই অভিযোগ নিয়ে আসেন। তাঁরা সবাই আমাদের ছাত্র হওয়ায় তাঁদের তো আর বের করে দেওয়া যায় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেসবাহ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরার পর পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে জানান, উপাচার্য অসুস্থ থাকায় ছুটিতে রয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, কলা অনুষদে ছয় শিক্ষার্থীর বিষয় বরাদ্দ নিয়ে তাঁদের কাছে অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভুল হতেই পারে—এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের আরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে মেধাতালিকা অনুযায়ী ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফরম পূরণের মাধ্যমে বিষয় বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। দেশের অধিকাংশ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবেই বিষয় বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীকে সনাতন পদ্ধতিতে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিষয় বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অনিময় হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই আমরা বর্তমান সরকারের আমলে প্রণয়ন করা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা তা শোনেননি। এখন বিষয় বরাদ্দ নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের অনেক অভিযোগ উঠছে।’
ভর্তি নিয়ে যত অভিযোগ: গত রোববার মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর বিষয় বরাদ্দের সাক্ষাৎকার শুরু হয়। কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকার শুরুতে থাকা অষ্টম, ৪১, ৪৮, ৯৩ ও ১০৬তম স্থান লাভ করা শিক্ষার্থীকে ক্রমানুসারে পেছনের বিষয় ইসলামিক স্টাডিজ দেওয়া হয়। তা ছাড়া সব শর্ত পূরণ হওয়ার পরও মেধাতালিকার ৪৩৯তম অবস্থানে থাকা একজনকে দেওয়া হয়েছে বাংলা বিষয়। আর ৪৯২তম স্থান পাওয়া একজনকে দেওয়া হয়েছে ওপরের দিকের বিষয় ইংরেজি।
এদিকে কলা অনুষদে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেছেন, ভর্তির সব শর্ত পূরণ করার পরও গত তিন দিনের সাক্ষাৎকারে প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থীকে কাঙ্ক্ষিত বিষয় দেওয়া হয়নি। মানবিক বিভাগ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ের জন্য ৭০টি আসন বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু শুরুতে এ বিষয়ে ৭৯ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হয়। পরে শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে ভুল স্বীকার করা হয়। কলা অনুষদের ডিন ও ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান মিলে অতিরিক্ত নয়জনের মধ্যে চারজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা বিষয় দিয়েছেন।
এদিকে গত রোববার সাক্ষাৎকারের প্রথম দিনে মেধাতালিকায় ৪৩৯তম হয়েও এক শিক্ষার্থী পেয়েছেন ইংরেজি বিষয়। কিন্তু পরদিনই আবার বিভাগ পরিবর্তন করে তাঁকে দেওয়া হয়েছে বাংলা। একই অবস্থা হয়েছে এমন আরও সাত শিক্ষার্থীর বেলায়ও।
এ প্রসঙ্গে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, এ ধরনের অনিয়ম করার জন্যই একটি প্রতিষ্ঠিত, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.