সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানিতে ১৪৩ কোটি টাকার অনিয়ম by অনিকা ফারজানা

বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানিতে (বিএসসিসিএল) তিন অর্থবছরে ১৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৭১ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ (পিটিঅ্যান্ডটি) নিরীক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।
একই কাজের নামে একাধিক বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসার্যা , মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই সাবমেরিন কেবলের ব্যান্ডউইডথ বাড়াতে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ, মুনাফার টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির চেয়ে বেশি অর্থ দেওয়াসহ ২৪টি শ্রেণীতে এসব আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে সাবমেরিন কেবলের ক্যাপাসিটি ব্যান্ডউইডথ ৪৪ দশমিক ৬ গিগাবাইট। এর মধ্যে ব্যবহূত হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ গিগাবাইট। তাতে ২৪ থেকে ২৯ গিগাবাইট অব্যবহূত থাকে। এ অবস্থায় আরও ১০০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইডথ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিজস্ব আর্থিক ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে এ ক্ষেত্রে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
নিরীক্ষা আপত্তিতে বলা হয়েছে, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) থেকে বিএসসিসিএল ঋণ নিয়েছে ১৪৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এখনো ঋণের পরিমাণ ৭৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই ঋণ মাথায় নিয়ে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ব্যান্ডউইডথ বাড়াতে বিপুল অর্থ খরচ করা যুক্তিযুক্ত নয়। প্রতিষ্ঠানটি মন্ত্রণালয়ের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই বিদেশি কোম্পানি এসএমডব্লিউফোর সেন্ট্রাল বিলিং পার্টি মালয়েশিয়াকে ৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যান্ডউইডথ আপগ্রেডেশনের এ কাজ করা হয়েছে।
বিএসসিসিএল বিভিন্ন খাত ও উপখাতে বাজেটে অর্থের সংস্থান না রেখেই ৩১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ব্যয় করেছে। কেব্ল সিস্টেম তৃতীয় পর্যায় উন্নয়নের জন্য টিএম মালয়েশিয়া নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারি আদেশ অনুযায়ী, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট আদায় করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভ্যাট আদায় করা হয়নি। এতে সরকারের দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে বিএসসিসিএল ২০ কোটি ১৯ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে, যা মূলধনের ৩০ শতাংশ। লভ্যাংশের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ১৭ কোটি টাকা ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা হয়। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এ নিয়েও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তি জানানো হয়েছে।
ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী, আইপিএলসি রেন্ট ও ভ্যাট আদায় করছে না বিএসসিসিএল। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। দিন দিন এ অঙ্ক আরও বাড়ছে। এ ব্যাপারে বিএসসিসিএল কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।
বিএসসিসিএলের বেতন-ভাতা প্রসঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী সর্বনিম্ন ধাপ চার হাজার ১০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ধাপ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মূল বেতন ৯৫ হাজার টাকা ও মহাব্যবস্থাপকের মূল বেতন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এই উচ্চ বেতন সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনহীন নিজস্ব কাঠামোর মাধ্যমে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ করা হয়েছে দুই কোটি ৪১ লাখ টাকা। আরও ওই বেতন কাঠামো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নয় বলেও আপত্তি জানিয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘নিরীক্ষা বিষয়ে অধিকাংশ আপত্তির যথাযথ উত্তর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিগগির আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, বেতন কাঠামো অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাটবিষয়ক জটিলতা শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এসব ক্ষেত্রে কতটুকু ভ্যাট লাগবে, সে বিষয়ে এনবিআরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.