বিজয় দিবসঃ স্মৃতিসৌধে জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা

গায়ে লাল-সবুজ জামা, কপাল ও হাতে লাল-সবুজের চিহ্ন; সারি সারি মানুষ ছুটছে মিলন মেলায়। সবার গন্তব্য সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। মিছিল থেকে দেশাত্ববোধক গান, আর স্লোগান- যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই।
মহান বিজয় দিবসে রোববার কাক ডাকা ভোরে স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের কণ্ঠে এভাবে ভেসে উঠেছে একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠন ও নানা প্রতিষ্ঠান ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আওয়াজ তুলেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের।

সকাল সাড়ে ৬টার পরে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গকে নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শহীধ বেদিতে। এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন কূটনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধু, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিবর্গ।

প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সবার জন্য।

৭টা ৩৮ মিনিটে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান একাত্তরের শহীদদের। এরপর আসেন গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, জাতীয় পার্টি থেকে দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, এলডিপির অলি আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিকল্প ধারার মাহি বি চৌধুরী, গণসংহতির জোনায়েদ সাকীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী, সরকারি কর্ম কমিশন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্তারা শ্রদ্ধা জানান শহীদ বেদিতে।

pm-savarফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সেক্টর কমান্ডরস ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মসহ বিভিন্ন সংগঠন।

বেলা ১২টা নাগাদ ফুলে ফুলে ভরে যায় স্মৃতিসৌধের বেদির পাদদেশ।

শ্রদ্ধা জানাতে আসা প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনের মিছিলে দাবি উঠে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের।

বিচারের দাবিতে স্মৃতিসৌধ চত্বরে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতীকী অনশন, নাটকে প্রতীকী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।

দেশের বিশিষ্ঠজনদের মুখেও উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বাবা শরিফুল ইসলাম ও মা শরিফা খাতুনের সঙ্গে বিজয়ের আনন্দে সাভারের বাইপাইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়াও এসেছিল স্মৃতিসৌধে।

শরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নতুন প্রজন্মকে দায়মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে। ওদেরকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে হবে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নাটকের আয়জন করে।

মুক্তিযোদ্ধা পাগল মুক্তিযোদ্ধার প্রতীকী সাজে ঘুরে বেরিয়েছেন স্মৃতিসৌধে।

তেমনি একজন নোয়াখালির সেনবাগের আব্দুল মোতালেব হিরুর কণ্ঠে ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি। হিরু বাংলানিউজকে বলেন, ঘরে শত্রু রেখে আজকের এই আনন্দ শুধুই অভিনয়। ঘরের শত্রু যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে দেশের মানুষকে স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধের আনন্দ দেওয়ার আহ্বান জানান সরকারের প্রতি।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে আগামী ১৮ ডিসেম্বর হরতালের সমর্থনে স্লোগান দেয় সিপিবি ও বাসদ এবং তাদের অঙ্গ সংগঠন।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধারপরাধীদের এদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। বহু পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি অসম্পুর্ন গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু সেটাও নির্বিঘ্ন নয়। তার পরও আমি বলবো অন্তত পক্ষে আমাদের সংবিধানের মূলনীতিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।

kalada-saverতিনি বলেন, যদিও সম্পুর্ণভাবে আমরা পারিনি। এখনো পর্যন্ত সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ, জিয়া এবং  এরশাদের  বিধানগুলো এখনো বলবত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যাত্রার শুরু থেকে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, বিতর্কিত করার জন্য, বানচাল করার জন্য বিভিন্ন সময় দাবি তোলা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবি জানিয়েছে আসছে। তাই সময় এসেছে আমাদের এক হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য।

সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল সৃষ্টি করার জন্য দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি তারা আজও বীরদর্পে চলছে। জামায়াত-শিবির হরতালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। তারা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে বলে মনে করেন সেলিম।

স্মৃতিসৌধে এসে অনেক তরুণ ও তরুণী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা বাংলানিউজকে বলেন, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যেত তবে আমরা আজকে প্রাণখুলে বিজয় উৎসব করতে পারতাম।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও এই বিচার দ্রুত শেষ করার জন্য জোর দাবি জানান।

প্রতিবেদকঃ জাহাঙ্গীর সুমন, ইসমাইল হোসেন, মফিজুল সাদিক, ইমরান আলী ,ওমর ফারুক ও ওয়ালিউল্লাহ

No comments

Powered by Blogger.